ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২ শ্রাবণ ১৪৩২, ১৭ জুলাই ২০২৫, ২১ মহররম ১৪৪৭

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

কংক্রিটের আস্তরণে প্রাণশক্তি হারাচ্ছে সিআরবির গাছ 

সোহেল সরওয়ার, সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১:১৪, জুলাই ১৭, ২০২৫
কংক্রিটের আস্তরণে প্রাণশক্তি হারাচ্ছে সিআরবির গাছ  ছবি: সোহেল সরওয়ার

চট্টগ্রাম: রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তর সিআরবি এলাকা চট্টগ্রামের ফুসফুস। এখানকার জঙ্গলে চার বছর আগে সন্ধান পাওয়া ১৮৩টি ঔষধি গাছের অধিকাংশই এখন নেই।

বড় বড় গর্জন, শিরীষ, সোনালুসহ নানা প্রজাতির গাছপালা হারাচ্ছে প্রাণশক্তি।

সিআরবি শিরীষতলা এলাকায় প্রতিদিন আসেন নানা বয়সী মানুষ।

গাছের ছায়ায় তারা খুঁজে নেন প্রশান্তির আশ্রয়। ৭০-৮০ বছরের বেশি বয়সের বড় গাছগুলোর ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাওয়া দেখে পরিবেশকর্মীরা উদ্বিগ্ন হন, দোষ দেন গাছ ঘিরে রাখা কংক্রিটের আস্তরণকে।

সরেজমিন দেখা যায়, রাস্তার পাশে থাকা শতবর্ষী একটি শিরীষগাছ গুনছে মৃত্যুর প্রহর। উঠে গেছে বাকল, কেটে নেওয়া হয়েছে বড় ডালপালা। ফুটপাতে ৬টি ও সড়কের মাঝখানে ৮টি গর্জন গাছের বয়স এখন ৭৫-৮০ বছর। সেগুলোর গোড়া কংক্রিকেটের সাথে সিমেন্টের মিশ্রণ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।

প্রায় ২৫ থেকে ৩৫ মিটার গড় উচ্চতার এসব গাছের ডালপালা শুকিয়ে যাচ্ছে। শিকড়ে দেখা দিয়েছে পচন। কয়েকটি গাছের বাকল শুকিয়ে গেছে। ঝরে পড়ছে পাতা। কেটে ফেলা গাছের গুঁড়িও দেখা গেছে সিআরবিতে। একটি সোনালু গাছ এখনও টিকে আছে এই যুদ্ধে।

ব্রিটিশ আমলে তৈরি সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং এখানে অবস্থিত। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আবদুর রবসহ ৭ জনের কবরও রয়েছে সিআরবিতে। দুই বছর আগে শতবর্ষী গাছগুলো কেটে এখানে ৬ একর জমিতে হাসপাতাল তৈরির প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, যা চট্টগ্রামবাসীর প্রতিবাদের মুখে বাতিল করা হয়।

২০২৪ সালে ৬ কিলোমিটার রাস্তা করতে টাইগারপাস-সিআরবির শতবর্ষী ৪৬টি গাছ কেটে র‌্যাম্প নির্মাণের সিদ্ধান্তে বিক্ষোভ করেন চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ।  এতে রক্ষা পায় এসব গাছ। তবে রাস্তায় চলাচলরত যানবাহনের চাপ গাছের শিকড় ও কাণ্ডের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে।

পাশাপাশি ১০-১২ বছর ধরে গাছগুলোর ডালপালায় মড়ক লাগার পরও সেগুলোকে বাঁচাতে দৃশ্যমান কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সরানো হয়নি কংক্রিটের আস্তরণ। গাছের গোড়ায় পানি ও জৈব সার প্রয়োগের ব্যবস্থাও নেয়নি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন এর সংগঠক ডা. মনজুরুল করিম বিপ্লব বলেন, অসচেতনতা ও অবহেলায় ইতিহাসের সাক্ষী সিআরবি’র গাছগুলো ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে। গাছের গোড়া কনক্রিট দিয়ে মোড়ানো, সাথে পিচঢালা রাস্তায় গাড়ি চলাচল আর শব্দ দূষণে হারাচ্ছে জীববৈচিত্র্য।

চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের অনার্স ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী তানজুমা রহমান বলেন, চট্টগ্রামের ফুসফুস সিআরবির গাছগুলো দেখলে মায়া হয়। এসব গাছের নিচে গিয়ে প্রাণভরে শ্বাস নেই। মাঝেমধ্যে ভাবি, গাছগুলো টিকে থাকবে তো।  

বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) বন রক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আহসানুর রহমান জানান, গাছের গোড়া চারদিক থেকে কংক্রিটের আস্তরণে ঢাকা থাকার ফলে শিকড় বৃদ্ধি হচ্ছে না। পানি ও আলো-বাতাস পর্যাপ্ত পাচ্ছে না। শতবর্ষী গর্জন ও শিরীষগাছগুলোর জীবনশক্তি কমে আসছে।

বিএফআরআই অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছে, সিআরবিতে গাছের বৃদ্ধি ও টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক পরিবেশের অভাব রয়েছে। কোনও ছত্রাকের আক্রমণে গাছগুলো মরছে না, মারছে মানুষ। এসব গাছ বাঁচাতে গোড়ার চারপাশ থেকে কংক্রিটের আস্তরণ সরিয়ে মাটি উন্মুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছের প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ওমর ফারুক রাসেল বলেন, সিআরবি এলাকায় মোট ২২৩ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া গিয়েছিল।  এর মধ্যে গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ ৩৪ প্রজাতির, লতাজাতীয় উদ্ভিদ ২২ প্রজাতির। বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ৯টি। ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হতে পারে-এ রকম উদ্ভিদ ৬৬টি। এলাকাটিতে বড় বৃক্ষ রয়েছে ৮৮টি। যার মধ্যে শতবর্ষী গর্জন ও শিরীষ আছে। আমাদের উচিত এই গাছগুলো সংরক্ষণ করা।

এসএস/এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।