সিডর পেরিয়েছে ৮ বছর। উপকূলবাসীর জীবনযাত্রায় রেখে গেছে ভয়াবহ আচড়।
সিডর বিধ্বস্ত প্রান্তিক জনপদ ঘুরে: এই দিন আইলেই আর ঘুমাইতে পারি না। চৌখ (চোখ) বুজলেই দেহি লাশ আর লাশ। হুনতে (শুনতে) পাই স্বজনদের চিৎকার। বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের ভয়াবহ সেই বন্যার কথা এভাবেই বলছিলেন আবু জাফর (৪৫)।
সিডরের সেই রাতে তিনি হারিয়েছেন তার পরিবারের ৬ সদস্যকে। তাইতো সেই রাতের কথা মনে পড়লে অজান্তেই জল এসে যায় তার চোখে। তবু বলছিলেন সেই সময়ের কথা।
মহাবিপদ সংকেতের কথা শুনে আতঙ্কিত বরগুনা উপকূলের মানুষ। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির সঙ্গে দমকা হাওয়া বইছে। কেউ কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে গেলেও বেশিরভাগ মানুষই রয়ে গেলো নিজের ঘরে। তাদের মনে হয়েছিল এরকম ঝড় তো প্রতিবারই আসে, এতে আর কি হইবে। রাত ১০টার দিকে আঘাত হানলো সিডর। মাত্র ১০মিনিট স্থায়ী এই জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের কয়েক হাজার মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। পুরো এলাকা হয়ে গেলো লণ্ডভণ্ড। চারিদিকে ধ্বংসলীলা। নদীতে দেখা গেলো লাশের পর লাশ। কবর দেওয়ার জায়গা পাওয়া যাচ্ছেনা। এক একটি কবরে ২/৩ জনের লাশ ফেলে মাটি চাপা দেওয়া হলো।

undefined
বরগুনা সদর উপজেলার মাঝের চর গ্রামের আবদুর রশিদ নিজ চোখে সেদিন দেখেছিলেন সিডরের ভয়াবহতা। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, সিডরে নিজের চোখের সামনে একমাত্র ছেলেকে হারিয়েছি। বাবা কাধে ছেলের লাশ কি যে যন্ত্রণার তা বলে বোঝানো যাবে না। সেই রাত আর পরের দিনের বিধ্বস্ত জনপদ আজীবন বরগুনাবাসীর মনে ক্ষত হয়ে থাকবে যা কখনো শুকাবে না।
বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের রোজিনা বেগম সিডরের সময় হারিয়েছেন তার ৫ বছর ও ২৪দিন বয়সী দুই সন্তানকে। তাই এ দিন এলেই তার চোখের ঘুম চলে যায়। সারারাত কাঁদেন ঘরের মেঝেতে বসে।
এরকমই স্বজন হারানোর বেদনায় ভারী হয়ে উঠেছিলো বরগুনাসহ গোটা উপকূল। বরগুনা সদর উপজেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার নাম নলটোনা। যেখানে সিডরের এক বছর আগে থেকেই বেড়িবাঁধ ছিলনা। সিডরের সময় সেখানে ২০ ফুটের মতো পানি বৃদ্ধি পেয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ের পরের দিনই সেখানে অর্ধ শতাধিক মানুষের লাশ পাওয়া যায়। তখনও এলাকাটি পানির নিচে হাবুডুবু খাচ্ছিল। লাশ দাফনের জন্য উঁচু কোনো স্থান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলনা। লাশগুলো নিয়ে আসা হয় বরগুনা-নিশানবাড়িয়া সড়কের পাশে পশ্চিম গর্জনবুনিয়া গ্রামে। দাফনের কাপড় ছাড়াই ৩৩জনকে ১৯টি কবরে মাটি চাপা দেয়া হয়। জায়গার অভাবে ৫টি কবরে ৩জন করে ১৫জন, ৪টি কবরে ২জন করে ৮জন ও ১০টি কবরে একজন করে ১০ জনের লাশ দাফন করা হয়। কবরগুলোকে একটু উঁচু করে রাখা হয়েছে।

undefined
বরগুনা প্রেসক্লাবের সহযোগিতায় স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা সংগ্রাম সম্প্রতি ইট দিয়ে কবর স্থানটি ঘিরে দিয়েছে। সারিবদ্ধ কবর দেখে মানুষ এসে থমকে দাঁড়ায়। কেউ কেউ কান্না চেপে রাখতে পারেননা। সিডরের স্মৃতি হয়ে আছে কবরগুলো।
কবরগুলোতে শুয়ে আছেন, নলটোনা গ্রামের তাসলিমার বাবা আবদুর রশিদ (৫৫), মা আম্বিয়া খাতুন (৫০), ছেলে আল আমিন (৭), ফোরকানের বাবা দিন আলী (৬৫), হাসি বেগমের মেয়ে শাহিনুর (৪), শাহজাহানের মা তারাভানু (৬০), মেয়ে খাদিজা আক্তার (৩), আনিসের স্ত্রী খাদিজা বেগম (৩০), ছেলে আবু বকর (৩), রফেজ উদ্দিনের স্ত্রী বিউটি বেগম (৩৫), মাসুমের মা হেলেনা আক্তার (৩০), বাদলের মা লালবরু (৬৭), বাবুলের মেয়ে জাকিয়া আক্তার (৮), আবদুস সত্তারের স্ত্রী সাফিয়া খাতুন (৩০), ছেলে রেজাউল (১২), রেজবুল (৭), মেয়ে সাবিনা (৯), সগির হোসেনের মেয়ে সোনিয়া আক্তার (৩), আবদুর রবের ছেলে হোসেন আলী (১২), মেয়ে ময়না (৭), হোসনেয়ারা (৫), শাশুড়ি মনোয়ারা বেগম (৫০), সরোয়ারের স্ত্রী জাকিয়া আক্তার (৩০), মেয়ে রোজিনা (৪), ছত্তারের স্ত্রী বেগম (৫০), পুত্রবধূ নাজমা আক্তার (৩০), নাতি পারভেজ (৪), নাসির উদ্দিনের স্ত্রী হোসনেয়ারা (২৬) ও গর্জনবুনিয়া গ্রামের গনি বিশ্বাসের ছেলে জাহিদ হোসেন (৫) ও খাদিজা আক্তার (৩০)। বাকী ৩ জনের নামপরিচয় আজও জানা যায়নি।

undefined
বরগুনা প্রেসক্লাবের সভাপতি হাসানুর রহমান ঝন্টু বাংলানিউজকে বলেন, প্রলয়ংকরী সিডরের নিহতদের স্মরণে সরকারি উদ্যোগে কোনো স্মৃতি-স্তম্ভ করা হয়নি। তাই প্রেসক্লাব স্থানীয় উন্নয়ন সংগঠন সংগ্রামের সহযোগিতায় সদর উপজেলার নলটোনা গ্রামে একই কবরে ৩৩ জনকে দাফন করা স্থানটিকে সিডর স্মৃতি হিসেবে ব্যবহার করছি। প্রতিবছর সিডর দিবসে এখানে মানুষ আসে তাদের স্মরণ করতে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৫
এসএইচ