জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা এবং পরিবেশ রক্ষায় তরুণদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তাদের মতে, তরুণ প্রজন্ম সচেতন হলে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব।
রোববার (১ জুন) ঢাকার আগারগাঁওয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে অনুষ্ঠিত ‘ম্যানিফেস্টো টক: ইয়ুথ, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন রাজনৈতিক নেতারা।
অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা ড. মাহদী আমীন বলেন, বিগত স্বৈরাচার সরকার উন্নয়নের নামে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করে পরিবেশ ধ্বংস করেছে। এসব প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। প্রকল্প গ্রহণের আগে তা পরিবেশবান্ধব কি না, তা যাচাই-বাছাই করা হয়নি। তিনি বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে পরিবেশ ধ্বংস হতে পারে-এমন কিছু বিএনপি তার নির্বাচনী ইশতেহারে রাখবে না।
তিনি আরও বলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সবুজ বিপ্লবের যে পরিকল্পনা করেছিলেন, তা বাস্তবায়ন করা হবে। সারা দেশে সবুজায়ন বাড়াতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ইতোমধ্যে গাছ লাগানোর কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এখন সময় এসেছে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ রক্ষায় রাজনৈতিক দলগুলোকে এক ছাতার নিচে আনার। কারণ, সময় যত যাচ্ছে, বাংলাদেশ ততই জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিতে পড়ছে। নির্বাচনী ইশতেহারে তার দল বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে। তিনি আরও বলেন, যারা নদ-নদী, খাল-বিল দখল করছে ও বন উজাড় করছে, তারা আগামী নির্বাচনে যেই প্রতীকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক না কেন, তরুণদের উচিত তাদের ভোট না দেওয়া।
‘ম্যানিফেস্টো টক’-এর কনভেনর হাবিব রহমান বলেন, তরুণদের সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কাজ করলে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হতে পারবে।
ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এনডিএম)-এর চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে তার দল জলবায়ু ও পরিবেশের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। সামনের নির্বাচনেও তরুণদের এই প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটবে। এমনকি তার দল ক্ষমতায় না গেলেও তরুণদের দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’র কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, তরুণদের শক্তিই পারে দেশকে জলবায়ু ও পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে। তিনি জানান, তাদের দল ইতোমধ্যে নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে কাজ শুরু করেছে এবং জলবায়ু ও পরিবেশকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, তরুণরা যদি নিজেরা অভ্যাস পরিবর্তন না করে এবং দায়িত্বশীল না হয়, তবে শুধু বাজেট বা ইশতেহারে গুরুত্ব দিলেও কোনো ফল আসবে না।
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন এখন শুধু বাংলাদেশের বিষয় নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সংকট। উন্নত দেশগুলোর কারণেই আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর এখন ভাবতে হবে-এই সংকট মোকাবিলায় তরুণদের কীভাবে যুক্ত করা যায়।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, রাজধানী ঢাকা এখন পরিবেশ বিপর্যয়ের শীর্ষে। জনসচেতনতা বাড়াতে না পারলে শুধু রাজনৈতিক ইশতেহারে গুরুত্ব দিলেই সমাধান আসবে না।
গণসংহতি আন্দোলনের নেতা আবুল হাসান রুবেল বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে তার দল জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিষয়টিকে শুরুতেই স্থান দিয়েছিল। তিনি বলেন, পরিবেশ রক্ষা না করতে পারলে শুধু ভোটের মাধ্যমেই দেশকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। তাই তরুণদের মতামত ইশতেহারে গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
৫ আগস্টে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র জয়েন্ট কনভেনর আরিফুল ইসলাম আদিব বলেন, দখলদাররা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পরিবেশ, নদী, খাল-বিল ও বন ধ্বংস করছে। তরুণদের নেতৃত্বে গঠিত এনসিপি সবসময় তাদের চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত দল নেবে না।
আলোচনার প্রধান অতিথি বন, পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার পরিবেশ রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। বায়ু দূষণ ও নদী দখল রোধে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দখলদারদের ছাড় দেওয়া হবে না। তবে তিনি বলেন, এই সংকট মোকাবিলায় রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন। তিনি তরুণদের উদ্দেশে বলেন, যেন তারা অর্থ, ক্ষমতার মোহ বা দুর্নীতির পথে না হাঁটে এবং সব বিষয়ে স্বচ্ছতা বজায় রাখে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ তরুণদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, তার সংস্থা পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছে। কিন্তু একটি মহল তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা পর্যাপ্ত নয় বলেও অভিযোগ করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, রাজধানী রক্ষায় নদীগুলোকে রক্ষা করতে হবে এবং সবুজায়ন বাড়াতে তরুণদের নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে।
পরিবেশকর্মী শরীফ জামিল বলেন, বিগত স্বৈরাচার সরকার উন্নয়নের নামে মাতারবাড়ি, পায়রাসহ নানা প্রকল্প নিয়ে পরিবেশ ধ্বংস করেছে। তাদের কোনো পরামর্শ কানে নেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে এই বিষয়গুলো গুরুত্ব না পেলে জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না।
সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডায়ালনের প্রধান নির্বাহী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, বিগত সরকারের আমলে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থ লুটপাট হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় বরাদ্দ অর্থের বেশির ভাগই ব্যয় হতো স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে, যার অনেকটাই দুর্নীতিপূর্ণ ছিল। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে জলবায়ু অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, তরুণদের এগিয়ে আসা নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা না থাকলে পরিবেশ রক্ষা সম্ভব নয়।
অনুষ্ঠানের শেষে প্রাণী ও মৎস্য বিষয়ক উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার বলেন, হাওর-বাঁওড় টিকে থাকলে বাংলাদেশও টিকে থাকবে। তাই সবাইকে নিয়ে এ ধরনের আলোচনা আরও বেশি করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে, আর এটি তরুণরাই করতে পারে। তাহলেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা সম্ভব।
‘ম্যানিফেস্টো টক: ইয়ুথ, ক্লাইমেট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ শীর্ষক এ আলোচনা সভার আয়োজন করে সচেতন ফাউন্ডেশন, ব্রাইটার্স, সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডায়ালগ, সেন্টার ফর অ্যাটমোসফিয়ারিক পলিউশন স্টাডিজ, সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট রিসার্চ, হিউম্যান সেফটি ফাউন্ডেশনসহ ১৫টি পরিবেশবাদী সংগঠন।
অনুষ্ঠানে পরিবেশ বিষয়ক তরুণদের নতুন জোট ‘বাংলাদেশ ইয়ুথ ক্লাইমেট কোয়ালিশন’-এর উদ্বোধন করেন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি তরুণদের এই উদ্যোগের সফলতা কামনা করেন এবং পরিবেশ রক্ষায় একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।