১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে শাহাদাতবরণ করেন রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান। তার মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
রাজনৈতিক ইতিহাসবিদদের মতে, এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ভোরে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করেন এবং নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন। পরে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। কিছু বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি নিজের শাসন দীর্ঘ করতে চাইলেও পারেননি। তীব্র থেকে তীব্র আন্দোলন, এক পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থান তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে।
তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির বর্ণনা করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, ১৯৮২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারের মন্ত্রিসভার সদস্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল কাশেমের (যিনি তখন যুব প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন) মিন্টো রোডের বাড়ি থেকে সন্ত্রাসী ইমদাদুল হক ওরফে ইমদুকে আটক করা হয়। বলা হয়ে থাকে, এরশাদই নাটক করে ইমদুকে সেখানে রেখেছিলেন। পরে এরশাদ তার অনুগত লোক দিয়ে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো নয় এটা বোঝানোর জন্য এই আটকের ঘটনা ব্যাপকভাবে সারাদেশে ছড়িয়ে দেন। এই গ্রেপ্তারের তিন দিন পরই (১১ ফেব্রুয়ারি) রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে দিয়ে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গঠনের ঘোষণা দিয়ে তারই মন্ত্রিসভা বাতিল করান এরশাদ। বলা হয়ে থাকে, এরশাদই তখন গোপনে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন, যা পরবর্তীকালে তার সামরিক শাসনের পথ প্রশস্ত করে। এর এক মাসের মধ্যে ২৪ মার্চ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সংবিধান বাতিল করেন, সংসদ ভেঙে দেন এবং সব রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
ওই সময় নিজের ক্ষমতা দখলের যুক্তি তুলে ধরে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হুসেইন এরশাদ বলেছিলেন, দেশে প্রশাসনিক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, দুর্নীতি ও অকার্যকর শাসনের কারণে রাষ্ট্র ও সমাজ বিপর্যয়ের পথে। তাই জাতীয় স্বার্থে সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, এরপর ১৯৮৩ সালে এরশাদ নিজেকে নিজেই ভোট ছাড়া রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। ধীরে ধীরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিয়ে তৃণমূলে নিজের শক্তি সংহত করেন। ১৯৮৬ সালে বিএনপির একাংশ, কিছু ধর্মীয় নেতা, চীনপন্থী বাম নেতাদের নিয়ে জাতীয় পার্টি গঠন করে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের রাষ্ট্রপতি পদকে বৈধতা দেন। এছাড়া ১৯৮৮ সালে অধিকাংশ দলের বর্জনের মধ্যেও নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন এরশাদ। কিন্তু দীর্ঘকাল তার শাসন করার পরিকল্পনা ধোপে টেকেনি। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন।
এরশাদ ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করলেও তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি এখনো বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকে আছে। এ পর্যন্ত বহুভাগে জাতীয় পার্টি বিভক্ত হলেও ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে দলটি বিরোধী দলের মর্যাদায় ছিল। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচন তিনটি বর্জন করলে আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে জাতীয় পার্টি নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেওয়া আসনে বিজয়ী হয়ে বিরোধীদলের আসনে বসে। এ কারণে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর জাতীয় পার্টিও নিষিদ্ধের দাবি জোরালো হয়েছে। দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তবে জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের বিপক্ষে মত দিয়ে ড. আবদুল লতিফ মাসুম বাংলানিউজকে বলেন, সবাইকে নিষিদ্ধ করলে নির্বাচন করবে কে? জনগণের ঘৃণা দ্বারা ভোটের মাধ্যমেই তারা নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। লেট দেম বার্ন। এতগুলো পার্টি নিষিদ্ধ হলে ভারত ও পশ্চিমারা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ নেবে।
এত সমালোচনা ও ভাঙনের পরও জাতীয় পার্টি কেন প্রাসঙ্গিক—এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটওয়ারী বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি এখন শুধু প্রাসঙ্গিকই নয় বরং শক্তিশালী ফ্যাক্টর। ১৯৯০ সালে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগের পর জাতীয় পার্টির ভোট তো কমেইনি, বরং আরও বেড়েছে। এছাড়া এখন নতুন যে দলগুলো সৃষ্টি হয়েছে তারাও জাতীয় পার্টির সমকক্ষ হতে পারেনি। এজন্য জাতীয় পার্টি এত ভাঙনের পরও প্রাসঙ্গিক।
নিষিদ্ধের দাবি প্রসঙ্গে দলটির মহাসচিব বলেন, এসব দাবি নিয়ে আমরা মোটেও বিচলিত নই। আমরা তো কোনো অন্যায় করিনি। আমাদের অন্যায় কী তারা বলুক। জাতীয় পার্টির বিপুল সংখ্যক কর্মী ও সমর্থক রয়েছে। তাই ভোটের মাঠে যাদের শক্তি রয়েছে তাদের নিষিদ্ধ করা সম্ভব নয়।
সম্প্রতি নতুন করে দ্বিধাবিভক্ত জাতীয় পার্টির পুনরেকত্রীকরণের সম্ভাবনার বিষয়ে জাপা মহাসচিব বলেন, নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে দাবি উঠলে আমরা বিবেচনা করবো। তবে এখনো সে দাবি ওঠেনি।
নির্বাচনে অংশ নেবেন কি না জানতে চাইলে তিনি জাতীয় পার্টির মূল অংশের এই মহাসচিব বলেন, আমরা সব সময় নির্বাচনমুখী দল। যদি ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত হয় আমরা অবশ্যই নির্বাচনে অংশ নেবো। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।
এরশাদের পতনের স্মৃতিচারণ করে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সাবেক ছাত্রনেতা ও বর্তমানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বাংলানিউজকে বলেন, স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন শুরু করেছিলাম। সেই আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি এনেছিলেন আমান-খোকন-বাবুলরা। ওই সময় আমাদের একটাই উদ্দেশ্য ছিল এরশাদের পতন ঘটানো আর দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা।
নব্বইয়ের অভ্যুত্থানের সঙ্গে চব্বিশের অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, সেই সময়ে ছাত্র আন্দোলন আর বর্তমানের ছাত্র আন্দোলনের পার্থক্য হলো, আমরা এরশাদের পতনের পর কেউ ক্ষমতামুখী হইনি। এখনকার ছাত্রনেতারা নিজেরাই নিজেদের দলই তৈরি করেছেন। আমাদের সময় কিছু ছাত্রনেতা মনোনয়ন চেয়েছিলেন, তাও ৫-৬ জনের বেশি নয়। এখন তো ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগও আসছে। কেউ কেউ উপদেষ্টাও হয়েছেন।
এনডি/