প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের ঢাকায় ভিসা সেন্টার খোলার অনুরোধ জানালেও সাড়া মেলেনি। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যেসব দেশ দিল্লি থেকে ভিসা দিয়ে থাকে, তাদের প্রতি তিনি অনুরোধ জানিয়েছিলেন, যেন দেশগুলো ঢাকায় বা বাংলাদেশের প্রতিবেশি অন্য দেশগুলোতে ভিসা সেন্টার খোলে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সে অনুযায়ী ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর দূতদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। গত বছর ৯ ডিসেম্বর আয়োজিত বৈঠকে ঢাকা ও দিল্লির ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশের মিশনের ১৯ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। সে সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতদের ঢাকায় ভিসা সেন্টার খোলার অনুরোধ জানান তিনি।
ভিসা অফিস খোলার অনুরোধ
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ১৯ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড অব ডেলিগেশন মাইকেল মিলার। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে যাদের ভিসা অফিস নয়াদিল্লিতে আছে, তাদের ঢাকা বা অন্য কোনো প্রতিবেশী দেশে ভিসা অফিস নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করেন।
তিনি বৈঠকে বলেন, ইউরোপীয় দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর ভিসা পেতে সমস্যা হয়। তারা যদি ভিসা সেন্টার ঢাকায় নিয়ে আসেন, তাহলে আমাদের ছেলেমেয়েদের ভোগান্তি কমে যাবে।
আহ্বান ছিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টারও
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনও উপস্থিত ছিলেন। তিনিও ইউরোপীয় দূতদের ভিসা অফিস ঢাকায় খোলা বা তৃতীয় কোনো দেশে স্থানান্তরের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তখন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বুলগেরিয়ার উদাহরণ দেন।
কারণ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে বুলগেরিয়া বাংলাদেশিদের জন্য তাদের ভিসা সেন্টার ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে স্থানান্তর করেছিল। এই উদাহরণ টেনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দিল্লিতে অবস্থানরত ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য দেশগুলোকেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণের আহ্বান জানান।
যে কারণে এই অনুরোধ
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে ঢাকা ও দিল্লির সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন থেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য বিভিন্ন ক্যাটাগরির ভিসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে বাংলাদেশি নাগরিকদের ভারতে যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
দিল্লি থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ভিসা নেওয়ার জন্যও বাংলাদেশিদের ভারতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। তবে ভারত ভিসা সীমিত করে দেওয়ায় বিপাকে পড়েন বাংলাদেশিরা। এ পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের বিকল্প হিসেবে তৃতীয় দেশ থেকে ভিসা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে বাংলাদেশ।
তিন দেশের বিকল্প ভিসা সুবিধা
ভারতের বিকল্প হিসেবে তৃতীয় কোনো দেশ থেকে ভিসা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের অনুরোধে সাড়া দিয়েছে মাত্র ইউরোপের তিনটি দেশ। এই তিনটি দেশ হলো- রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও কাজাখস্তান।
বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর ১০ সেপ্টেম্বর থেকে থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামে অবস্থিত রোমানিয়ার দূতাবাস থেকে বাংলাদেশিরা ভিসা আবেদন করতে পারেন। গত বছর ৪ অক্টোবর থেকে ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও কাজাখস্তানের বুলগেরিয়া দূতাবাস থেকে ভিসা আবেদন করতে পারছেন।
ইন্দোনেশিয়া থেকেও সাময়িকভাবে বুলগেরিয়ার ভিসা আবেদনের সুযোগ ছিল। আর চলতি বছর জানুয়ারি থেকে কাজাখস্তানের ব্যাংকক দূতাবাস থেকে ভিসা আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়। তবে এই তিন দেশের বাইরে আর কোনো দেশ থেকে ইতিবাচক সাড়া মেলেনি।
ইউরোপের যেসব দেশের ভিসা আবেদনে জটিলতা
বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভারতের ভিসা সীমিত হয়ে পড়ায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ভিসা নেওয়া এখন জটিল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা ও চাকরির জন্য ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের ভিসা দিল্লি থেকে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে বেশি।
এর মধ্যে অন্যতম হলো- পর্তুগাল, গ্রিস, লিথুয়ানিয়া, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়ার মতো দেশ। কেননা এসব দেশের দূতাবাস বাংলাদেশে নেই। তাই এসব দেশের ভিসা পেতে ভোগান্তি বেড়েছে। আবার ভারতের বিকল্প হিসেব যেসব দেশ থেকে ভিসা নিতে হচ্ছে, সেসব দেশেরও ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার ভিসা নিয়ে সেখান থেকে ইউরোপের কোনো দেশের ভিসা নেওয়া খুব সহজেই সম্ভব হচ্ছে না। এতে সময় ও অর্থেরও প্রয়োজন পড়ে বেশি।
ঢাকায় ভিসা অফিস কেন খুলছে না
ভারতের ভিসা সীমিত হয়ে পড়ায় ইউরোপের যেসব দেশ দিল্লি থেকে বাংলাদেশিদের ভিসা দেয়, তাদের ভিসা অফিস ঢাকায় খোলার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সেসব দেশকে অনুরোধ করা হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতদের বৈঠকেও এই অনুরোধ জানানো হয়। তারপরও কেন ভিসা অফিস খুলছে না, বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানান, ভিসা অফিস খুলতে একটি দেশকে নানা অনুমোদন নিতে হয়। আর এই সিদ্ধান্তটা কোনো দেশ হঠাৎ করে নিতে পারে না। এখানে আর্থিক ও জনবলের বিষয়টি জড়িত। এটা ধীরগতিতে হয়ে থাকে। আবার যে দেশ এটি করবে, সে দেশ নিজেদের স্বার্থও দেখবে।
৮ দেশের ভিসা সুবিধা দিচ্ছে সুইডিশ দূতাবাস
ঢাকায় নতুন করে কোনো দেশ ভিসা সেন্টার না খুললেও অনেক দূতাবাস একাধিক দেশের ভিসা আবেদনের সুবিধা দিচ্ছে। গত বছর ৮ ডিসেম্বর ঢাকার সুইডিশ দূতাবাস ঘোষণা দেয় যে তারা ইউরোপের আরও আট দেশের ভিসা আবেদন নেবে।
গত ১০ ডিসেম্বর থেকে বহুজাতিক ভিসা প্রোসেসিং সার্ভিস সংস্থা ভিএফএস গ্লোবাল ঢাকায় সুইডিশ দূতাবাসের সহযোগিতায় বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, লাটভিয়া, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, স্লোভেনিয়া বা সুইডেনে যাওয়ার জন্য শেনজেন ভিসা আবেদনের জন্য একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট সিস্টেম চালু করে।
ঢাকায় ইইউ সদস্য
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশ বর্তমানে ২৭টি। এর মধ্যে ঢাকায় ইইউ জোটের সদস্য নয়টি দেশের মিশন রয়েছে। এই দেশগুলো হলো- জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, স্পেন ও হাঙ্গেরি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য নয়, এমন বেশ কয়েকটি ইউরোপের দেশের মিশনও রয়েছে ঢাকায়। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, নরওয়ে, কসোভা, ভ্যাটিকান সিটি ও তুরস্ক। এসব দেশের বাইরে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের ভিসা নিতে গেলে বাংলাদেশি নাগরিকদের ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত মিশনে যেতে হয়।
ভিসা জটিলতা নিরসন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভিসা জটিলতা নিরসনে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন। গত ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা দূর করতে আমরা গভীরভাবে কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসা জটিলতা কীভাবে কমিয়ে আনা যায় এ নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য
দিল্লি থেকে ইউরোপের ভিসা জটিলতা নিয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশিদের নয়াদিল্লি থেকে ভিসা দেয়। কিন্তু আমাদের নাগরিকরা যদি দিল্লিতে না যেতে পারেন তাহলে তারা কী করবেন?
ভিসা কম দেওয়ার বিষয়টি দীর্ঘদিন চলতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, যদিও এমনটি দীর্ঘদিন চলতে পারে না। কিন্তু এখন আমাদের জনগণ ইউরোপের ভিসা পেতে দিল্লির বদলে ভিয়েতনাম যাচ্ছে। এ ছাড়া অনেকে পাকিস্তানের ইসলামাবাদেও যাওয়ার চিন্তা করছেন। যদিও ঢাকার সঙ্গে ইসলামাবাদের সরাসরি ফ্লাইট নেই।
টিআর/আরএইচ