২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটে। তিনি পালিয়ে যান ভারতে।
অভ্যুত্থানের পরপরই অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি বিশেষ করে রাজধানীতে ডাকাত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। জনতা রাস্তায় নেমে নিজেরাই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে।
ফ্যাসিস্ট পতনের তিন দিনের মাথায় ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে। শুরু থেকেই নতুন সরকারকে পড়তে হয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জে। যদিও পুলিশ বাহিনীতে নানা সংস্কার ও পুনর্গঠনের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই পুলিশের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা হয়। অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় এসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি কতটা হয়েছে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন স্থানে মব ভায়োলেন্স (দলবদ্ধ সহিংসতা), খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও ডাকাতির মতো অপরাধ ঘটছে।
৫ আগস্ট সরকার পতন ঘটলে তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন আত্মগোপনে চলে যান। এর পরদিন পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব পান মো. ময়নুল ইসলাম। ডিএমপি কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পান মো. মাইনুল হাসান।
পরে আবারও নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হিসেবে দায়িত্ব নেন বাহারুল আলম। আর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হন শেখ মো. সাজ্জাত আলী। পুলিশ প্রধান ও ডিএমপি কমিশনারের দায়িত্ব নেওয়ার অর্ধেক বছরেরও বেশি সময় কেটে গেল। পুলিশ সদরদপ্তর বলছে, পুলিশের মনোবল আরও চাঙ্গা করার জন্য মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
সবশেষ আলোচিত কয়েকটি ঘটনার দিকে তাকানো যাক।
গত ১ মার্চ রাজধানীর লালমাটিয়ায় চায়ের দোকানে ধূমপান করাকে কেন্দ্র করে দুই তরুণীকে লাঞ্ছিত করা হয়। এ ঘটনায় রিংকু নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
রাজধানীর ভাটারা এলাকায় গত ৪ মার্চ ছিনতাইকারী তকমা দিয়ে ইরানের দুই নাগরিককে মারধর করে উচ্ছৃঙ্খল জনতা। এতে ওই দুজন আহত হন। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ।
পুলিশের ভাষ্য, ইরানের এই দুই নাগরিক ছিনতাইকারী ছিলেন না। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন তারা। একপর্যায়ে ছিনতাইকারী তকমা দিয়ে তাদের মারধর করা হয়।
৬ মার্চ মাগুরায় ৮ বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে। ঘটনা ঘিরে দেশজুড়ে প্রতিবাদ হয়। অভিযুক্তদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে সাজা হয়।
গত ২২ জুন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদাকে ‘মব’ (উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিশৃঙ্খলা) তৈরি করে হেনস্তার পর পুলিশে সোপর্দ করা হয়। রাজধানীর উত্তরার বাসায় ঢুকে একদল লোক তাকে বের করে আনেন এবং জুতার মালা পরিয়ে দেয়। ঘটনাটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় পুলিশ জানায়, বিএনপির করা একটি মামলায় নূরুল হুদাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
৯ জুলাই পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের পাশে ব্যস্ত সড়কে প্রকাশ্যে মব সৃষ্টি করে একের পর এক পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয় ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে। সেই ভিডিও ভাইরাল হলে দেশজুড়ে তোলপাড় হয়।
২৬ জুলাই চাঁদাবাজির অভিযোগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মী আব্দুর রাজ্জাকসহ পাঁচজন গ্রেপ্তার হন। তারা গুলশানে একটি বাসা থেকে ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন, যা সিসিটিভিতে ধরা পড়ে। পুলিশ অবশ্য এক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়।
গত শুক্রবার (১ আগস্ট) রাজধানীর মহাখালীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জামাল হোসেন (৪০) নামে এক কর্মচারী দুর্বৃত্তদের গুলিতে আহত হন। গত সোমবার (৪ আগস্ট) রাতে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাসেল সারোয়ার বলেন, কারা, কেন জামানকে গুলি করেছে, তা জানা যায়নি। তবে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।
৩ আগস্ট (রোববার) খুলনায় আল আমিন নামে এক মাছের ঘের ব্যবসায়ীকে গলাকেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। রাত ৯টার দিকে দৌলতপুর থানার মহেশ্বরপাশা বণিকপাড়ার খানাবাড়ি সড়কে তাকে গলাকেটে ফেলে রেখে যায় হত্যাকারীরা।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম জানান, ২০২৪ সালে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত ভীতিকর ও চরম উদ্বেগজনক।
তার ভাষায়, গত আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ পাওয়ার আশায় সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি প্রত্যাশা তৈরি হয়। তবে বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং সংশ্লিষ্টরা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাঙ্ক্ষিত সাফল্য দেখাতে পারেনি।
২০২৫ সালের জুলাই মাসে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)।
রাজনৈতিক সহিংসতার ৫৯টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৫ জন, আহত ৬৬১ জন। গোপালগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যৌথ বাহিনীর গুলিতে ৫ জন নিহত হন। বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বিভিন্ন দলের সঙ্গে সংঘর্ষ ছিল প্রধান ঘটনা।
সাংবাদিকদের ওপর ১৭টি হামলায় ২৭ জন নির্যাতনের শিকার হন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২০টি বাড়ি ও ২টি মন্দিরে হামলা হয়।
গণপিটুনির ৩২টি ঘটনায় ১২ জন নিহত হন। সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন ৬ জন, পুশইন করা হয় ৩৬৭ জনকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ৫ জন এবং হেফাজতে ১ জন নিহত হন। কারাগারে মারা গেছেন ৮ জন বন্দি।
নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাও ছিল উদ্বেগজনক—১৬২ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার, ধর্ষণের শিকার অন্তত ৬৮ জন। ২৩৩ জন শিশুর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে ৪২ জন। শ্রমিক নির্যাতনে নিহত ৫ জন ও দুর্ঘটনায় মারা গেছেন আরও ২১ জন।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে (২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত) দেশে খুনের মামলা হয়েছে ৩ হাজার ৮৩২টি। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১১টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৯৩৩টি এবং আগের ছয় মাসে ১ হাজার ৮৯৯টি মামলা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডসহ অনেক পুরনো ঘটনার মামলা বর্তমান সরকারের আমলে দায়ের হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে (২০০৯–২০২৪) অনেক ভুক্তভোগী মামলা করতে না পারায় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তারা এগুলো দায়ের করছেন। শুধু গত ১১ মাসেই এ ধরনের মামলা হয়েছে এক হাজারের বেশি।
অন্যদিকে, ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ১১ মাসে খুনের মামলা হয় ২ হাজার ৭৪২টি—গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৮টি করে খুনের ঘটনা ঘটেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পরপরই যে অবস্থা হয়েছিল দেশের সেখান থেকে কিছুটা উন্নতি হলেও ফ্যাসিস্ট শক্তি পুরোপুরিভাবে নির্মূল করা এখনো সম্ভব হয়নি।
‘আমি আগেও বলেছি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অপরাধীকে ধরে ফুলের শুভেচ্ছা দিয়ে বলবে, তোমরা ভালো হয়ে যাও, আর পুলিশের এই কার্যক্রম দেখে দেশের লোকজন বলবে, বর্তমান পুলিশ হচ্ছে মানবতার- বিষয়টি পুরোই হাস্যকর ও অপেশাদারত্বমূলক। কখনোই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় যদি পুলিশ কঠোর না হয়। ’
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, অপরাধের কয়েকটি ভাগ আছে, যেমন যখন তখন জনগণ দুর্ভোগে পড়ে, সড়ক অবরোধের কারণে, সেই অবরোধকারীদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ ছাড়া হত্যা, ছিনতাই, রাহাজানি, মব, দস্যুতা, ডাকাতি অন্যান্য অপরাধগুলো নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে কঠোর হতে হবে।
‘যেমন ধরুন, মব জাস্টিস, একটা লোকের ওপর মব চালানো হচ্ছে, অথচ পুলিশসহ আমরা অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। একটি দেশের জন্য এগুলো কোনমতেই কাম্য নয়। পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে যারা মবের সঙ্গে জড়িত, তাদের প্রতি সরাসরি অ্যাকশনে যেতে হবে। ’
তিনি বলেন, নতুন সরকারের বছর শেষের দিকে হলেও আমি মনে করি আইনশৃঙ্খলার সন্তোষজনক উন্নতি হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উন্মুক্তভাবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করার পরিবেশ পাচ্ছে না। এক বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা উন্মুক্তভাবে বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করে সমন্বিতভাবে কাজ করতে দেখছি না।
‘যেমন ধরুন পুলিশ বাহিনীর প্রধান একটি অপরাধ দেখে দ্রুত ব্যবস্থা, কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। কিছুক্ষণ পরই কোনো না কোনো স্বার্থের কারণে সরকারি মহল থেকে, কেউ না কেউ সেই নির্দেশ কিছুটা শিথিল করার জন্য তাকে চাপ দিল, এমন হলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। ’
তৌহিদুল হক বলেন, বর্তমানে দেশে অধিকাংশ মানুষের মধ্যে এখন অস্থিরতা বিরাজ করছে। নিরাপত্তা নিয়ে মানুষের মধ্যে ভয় আছে। কোনো জায়গায় একটু পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাবে, সেখানেও অস্থিরতার ভয় বা শঙ্কা কাজ করে। নিজের দেশের মধ্যে যদি জনগণ নিজের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত থাকে, তাহলে সরকারের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন জানিয়েছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান চলছে। অপরাধপ্রবণ এলাকায় বিশেষ টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, বড় শহর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে অপরাধীদের আটক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে তৎপরতা অব্যাহত, আর গোয়েন্দা নজরদারি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধী শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। পুলিশ সদস্যদের মনোবল বাড়াতে মাঠপর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল করে দক্ষ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে হটলাইন চালু ও সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, সীমান্তে চোরাচালান ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে বিশেষ নজরদারি চালানো হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এই কর্মকর্তা বলেন, গুজব ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ঠেকাতে সাইবার নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি অনলাইন জিডি, ৯৯৯ হটলাইন, দ্রুত অভিযোগ নিষ্পত্তি এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ।
এজেডএস/আরএইচ