২০২৪ সালের ৪ আগস্ট। জুলাই আন্দোলনের এই দিনে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটনায় তৎকালীন সরকার।
গত বছরের জুলাই আন্দোলনের নৃশংস ঘটনাগুলোর সঙ্গে ৪ আগস্টের ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ তিনজনেরর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে। যে মামলায় আসামি করা হয়েছে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে। যদিও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ইতোমধ্যে রাজসাক্ষী হয়েছেন।
ফরমাল চার্জ মোট ১৩৫ পৃষ্ঠার। এই ফরমাল চার্জ আদালতে তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. আব্দুস সোবহান তরফদার, মো. মিজানুল ইসলাম। যেটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। সেই চার্জের ভিত্তিতে ৩ আগস্ট থেকে বিচারও শুরু হয়েছে।
এ বিষয়ে গণমাধ্যমের তথ্য ও তদন্ত প্রতিবেদন থেকে ঘটনা তুলে ধরা হয়।
অসহযোগ আন্দোলন, ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড
সকাল ১০টা থেকেই ঢাকার শাহবাগে শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের সামনে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা জড়ো হয়ে সশস্ত্র অবস্থানে থাকে। তারা রিভলবার, পিস্তল, শট গান, কাঁটা রাইফেল, রড, রামদা এবং বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়। আন্দোলনকারীরা শাহবাগে পৌঁছালে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাদের মারধর করে। পরবর্তীতে ছাত্রদের ওপর দায় চাপানোর জন্য হাসপাতালের ভেতর আগুন লাগিয়ে দেয় সন্ত্রাসীরা। একই সময়ে বাংলামোটর, আজিমপুর, খিলগাঁও, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, টিকাটুলি, যাত্রাবাড়ী, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, মিরপুর-১০ এবং শাহবাগ এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।
হামলা, গুলি গ্রেনেড ও লাশ
বাংলামোটরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে গুলি ছুড়ে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। আজিমপুরে হাসিবুর রহমান মানিকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা চালায়। উত্তরায় শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো গুলিতে অন্তত ১৮ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে আওয়ামী লীগ কর্মীরা লাঠি ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে জড়ো হয়ে পুলিশকে সহযোগিতা করে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। খিলগাঁওয়ের অলি-গলিতে ছাত্রলীগ, পুলিশ ও সরকার-সমর্থিত সন্ত্রাসীরা একত্র হয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালায়।
সকাল দশটার পর ধানমন্ডি ২ নম্বর, সিটি কলেজ, সায়েন্সল্যাব এলাকায় জড়ো হতে থাকেন ইউল্যাব, স্ট্যামফোর্ড, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজসহ আশপাশের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। পুলিশ, ছাএলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সমর্থিত নেতাকর্মীদের নৃশংস হামলায় যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয় রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর এলাকা। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও গুলি করে, এতে হতাহতের খবর পাওয়া যায়।
সিলেট, রংপুর, পাবনা, কিশোরগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, কক্সবাজার, বরিশাল, বগুড়া, শেরপুর, ভোলা, জয়পুরহাট, সাভার, হবিগঞ্জসহ মোট ১৯ জেলায় সহিংসতায় মারা যান অন্তত ৯১ জন। বেশিরভাগই শিক্ষার্থী এবং নিরস্ত্র আন্দোলনকারী। শহীদদের মধ্যে বহুজন সরকারি বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান।
সরকারের কঠোর দমন-পীড়নের পদক্ষেপ হিসেবে বিকাল ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। সারাদিন আহত ও শহীদদের বহন করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে মিনিটে মিনিটে আসতে থাকে অ্যাম্বুলেন্স। আন্দোলনকারীরা শহীদ মিনার থেকে শাহবাগের দিকে মিছিলে স্লোগান দিতে থাকেন: “আমার ভাই মরল কেন? খুনি হাসিনা জবাব দে”, “দফা এক দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ”।
এছাড়াও খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশালসহ অধিকাংশ শহরে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় আওয়ামী ক্যাডাররা সশস্ত্র আক্রমণ চালালে মারাত্মক জখমের শিকার হয়।
এসব ঘটনাসহ জুলাই আন্দোলনের পুরো ঘটনায় যৌথ দায় হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিবন্ধন (১২৭ নং) করা হয়। ওই অভিযোগের প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক মো. জানে আলম খান। পরে তদন্ত করেন উপপরিচালক মো. আলমগীর (পিপিএম)। সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা। এ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরবর্তীতে ৩১ মে সম্পূরক অভিযোগ দেওয়া হয়। ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনার মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়। এ মামলায় ৩ আগস্ট সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর। বর্তমানে সাক্ষ্যগ্রহণ চলমান রয়েছে।
৫ আগস্টের পর ট্রাইব্যুনালে গত ২৫ জুন পর্যন্ত ২৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৩ জনকে। কারাগারে মৃত্যু হয়েছে এক আসামির।
ইএস/এমজেএফ