ঢাকা, সোমবার, ২০ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৪ আগস্ট ২০২৫, ০৯ সফর ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

মাইলস্টোনে দগ্ধ গাছ আর দুঃসহ স্মৃতির ভার

পিংকি আক্তার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৪১, আগস্ট ৩, ২০২৫
মাইলস্টোনে দগ্ধ গাছ আর দুঃসহ স্মৃতির ভার যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়া স্কুল ভবন

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এখন এক ‘ট্র্যাজেডি’র নাম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রাঙ্গণ ঘিরে এখনও কৌতূহলী চোখ আর ক্যামেরার ভিড় রয়ে গেছে।

আজ ১২দিন পর মাইলস্টোন স্কুলের গেট খুলেছিল, তবে গেটের বাইরে ছিল না অভিভাবকদের অপেক্ষা করার সেই চিরচেনা দৃশ্য। ছিল না শিশু-কিশোরদের প্রাণচাঞ্চল্য, ছোটাছুটি আর হইহুল্লোড়। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়া ভবনটির সামনের সারি সারি নারকেল গাছ এখনো দাঁড়িয়ে আছে, আগুনে দগ্ধ পাতার ক্ষত নিয়ে।

বিধ্বস্ত হওয়া স্কুল ভবনের বহু শিক্ষার্থীর নাম এখন আহত আর নিহতের তালিকায়। তাদের শোকে নিমজ্জিত অভিভাবক ও আত্মীয়স্বজনরা। ১২ দিন পরেও পুরো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক গভীর শোকের ছায়া, এক অপূরণীয় শূন্যতার উপলব্ধি। অনেক শিক্ষার্থীই স্কুলে এসে চোখের জল মুছছিল, শোকার্ত শিক্ষকরা কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে স্মৃতিচারণ করছিলেন মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানে।

২১ জুলাই বদলে দিয়েছে পুরো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ। সেই দিন অনেক শিক্ষার্থীর তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। সেই শূন্যতায় স্তব্ধ আছে পুরো শিক্ষাঙ্গন। সহপাঠী হারানো শিক্ষার্থীরা বারবার তাকিয়েছিল পুড়ে যাওয়া ভবনটির দিকে। কেউ কাঁদছিল চুপিচুপি, কেউ মুখ লুকিয়ে বসেছিল এক কোণে।

রোববার (০৩ আগস্ট) সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলে স্মরণসভা। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অনুষ্ঠানস্থলে ছিল কালো ব্যানার, নিহতদের ছবি, ফুল ও মোমবাতি। দুঃসহ স্মৃতির ভার যেন নীরবে বয়ে বেড়াচ্ছিল পুরো ক্যাম্পাস।



মাইলস্টোন কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন (অব.) জাহাঙ্গীর খান বলেন, “আমরা এখনও মানসিকভাবে এই দুর্ঘটনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তবে সবার সহযোগিতায় আবারও এগিয়ে চলার চেষ্টা করছি। ”

তিনি আরও বলেন, “শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনুরোধে ক্যাম্পাস খুলে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের জন্য বিশেষ কাউন্সেলিং সেশন চালু করা হয়েছে। ”

কলেজের আরেক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলম জানান, আগামীকাল সোমবারও ক্লাস হবে না, তবে শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে শিক্ষকরা তাদের সঙ্গে কথা বলবেন। নিয়মিত পাঠদান শুরু হবে বুধবার। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থার উন্নয়নে আগামী তিন মাস কাউন্সেলিং কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে আমাদের কেউ নিখোঁজ নেই। যাদের তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করা যায়নি, তাদের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছে। নিহতদের তালিকা কলেজের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে বিভ্রান্তি না থাকে। ”

অধ্যক্ষ জিয়াউল আলম জানান, আগামীকাল কলেজের পূর্বনির্ধারিত একটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। বেশির ভাগ অভিভাবক চান, শিক্ষার্থীরা যেন ধীরে ধীরে পড়াশোনায় ফিরে আসে।

প্রায় দুই সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের পা পড়ে আজ। তবে তাদের চোখে-মুখে ছিল ভয়ের ছায়া ও ট্রমা নিয়ে বেঁচে থাকার যাতনা। চিরচেনা প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীদের এই ফিরে আসা ছিল নীরব শোকযাত্রার মতো।



নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী সেদিনের ভয়াল চিত্র প্রত্যক্ষ করেছিল একেবারে সামনে থেকে। আজ ক্যাম্পাসে ফিরে এসে সেই দৃঃসহ স্মৃতি মনে করে আঁতকে উঠেছে সে। “আমার সামনেই বিমানটি ক্র্যাশ করে, একজন শিক্ষার্থীর শরীর ভেদ করে বিমানটি। সাথে সাথে ওর দেহটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। ১০ মিনিটের মধ্যেই ঘটনাস্তলে ফায়ার সার্ভিস আসে। ওই বীভৎস দৃশ্য আজও আমাকে ঘুমাতে দেয় না”, ভয়ার্ত চোখে বলছিল ওই শিক্ষার্থী।

৪০ বছর বয়সী এক নারী নাসিমা আক্তার; মিরপুর ১০ নম্বর থেকে এসেছেন পুড়ে যাওয়া স্কুল ভবনটি দেখতে। ভবনটির সামনে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। “আমার নিজের ১২ বছর বয়সী ছেলে আছে, ও মাদ্রাসায় পড়ে। ওর একটু জ্বর হলেই আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি। নিহত শিশুদের মায়েরা কীভাবে এই শোক সহ্য করছে!” কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বলেন নাসিমা।

ক্লাসরুমের পাশে নোটিশ বোর্ডে এখন কেবল বিমান বিধ্বস্তের ট্র্যাজেডি নিয়ে নানা তথ্য। পুরো নোটিশ বোর্ডজুড়ে এখন একটিই জরুরি নোটিশ, আহত- নিহতদের তালিকা!

কলেজের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ বুলবুল বলেন, “শিক্ষার্থীরা যেন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে, এ জন্য সীমিত পরিসরে ক্যাম্পাস খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারছে, যা তাদের মানসিক প্রশান্তিতে সহায়তা করবে। ”

তিনি আরও জানান, কলেজে বিমানবাহিনীর সহায়তায় একটি মেডিকেল ক্যাম্প চালু রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শ পাচ্ছে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে নিয়মিত কাউন্সেলিং করছেন। কেউ চাইলে ব্যক্তিগতভাবে একান্ত আলাপের সুযোগ পাচ্ছে।

রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনার কারণ, দায়দায়িত্ব ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে সরকার ৯ সদস্যের তদন্ত কমিশন গঠন করেছে। ওই তদন্ত কমিশনের সদস্যরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে এসে ঘটনার তদন্ত ও পর্যবেক্ষণ কাজ পরিচালনা করছেন।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।