ঢাকা, শনিবার, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ০২ আগস্ট ২০২৫, ০৭ সফর ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

জাতীয় সরকার গঠনে কেন রাজি হয়নি বিএনপি?

সিফাত বিনতে ওয়াহিদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:২৮, আগস্ট ২, ২০২৫
জাতীয় সরকার গঠনে কেন রাজি হয়নি বিএনপি?

ঢাকা: জাতীয় সরকার গঠন নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উত্তরসূরি দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে ফের তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।  

একদিকে বিএনপি দাবি করছে, তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা ছাত্রদের কাছ থেকে জাতীয় সরকারের কোনো প্রস্তাব পায়নি, অন্যদিকে এনসিপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে—প্রস্তাব ছিল, আলোচনাও হয়েছিল এবং তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে।

সত্যিই কি বিএনপিকে জাতীয় সরকারে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল? জাতীয় সরকার গঠনের প্রশ্নে বিএনপির এমন আপাত অনাগ্রহের পেছনে কারণই বা কী ছিল?

সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, “জাতীয় সরকারের কোনো প্রস্তাব ছাত্রদের পক্ষ থেকে তাদের দেওয়া হয়নি, তারা অন্য মাধ্যমে এ প্রস্তাব পেয়েছিলেন। ” এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন, ৫ আগস্ট রাতের প্রেস ব্রিফিংয়ে জাতীয় সরকার গঠনের ইচ্ছা প্রকাশ করার পর তারা ভার্চ্যুয়ালি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন, যেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জাতীয় সরকার ও নতুন সংবিধানের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল।  

তবে তারেক রহমান এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নাগরিক সমাজের সদস্যদের দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরামর্শ দেন বলে জানান নাহিদ ইসলাম। তিনি আরও দাবি করেন, ৭ আগস্ট ভোরে বিএনপি মহাসচিবের বাসায় গিয়ে তারা উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে আলোচনা করেন এবং উপদেষ্টা পরিষদ শপথ নেওয়ার আগমুহূর্তেও তারেক রহমানের সঙ্গে সম্ভাব্য সদস্যদের নিয়ে পর্যালোচনা হয়।

অবশ্য এসব বক্তব্যকে ভিত্তিহীন দাবি করে সোজাসাপ্টা অস্বীকার করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, “জাতীয় সরকারের ব্যাপারে আমাদের দল থেকে কোনো কথা বলা হয়নি। নাহিদ ইসলাম যে দাবি করেছেন, সেটা ঠিক নয়। এভাবে বললেই তো হবে না। ”

বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা নির্বাচনের মাধ্যমেই দেশের জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। তাদের মতে, জাতীয় সরকার নয়, বরং একটি নিরপেক্ষ ও দ্রুত নির্বাচনই সবচেয়ে জরুরি ছিল। তারা মনে করে, দীর্ঘ সময় ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত জনগণকে নির্বাচনেই তাদের প্রতিনিধিত্ব বেছে নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। আর নির্বাচনের পরেই আন্দোলনসঙ্গীদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন সম্ভব।

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, “বিএনপি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। এই গণতন্ত্রের জন্যই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গত ১৬-১৭ বছর আমরা লড়াই করেছি। নির্বাচনের পর সবাইকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করবে বিএনপি। ” তিনি জানান, বিএনপির প্রস্তাবিত ৩১ দফা সংস্কারের রূপরেখা অনুযায়ী তারা যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গীদের সঙ্গে ঐকমত্যে জাতীয় সরকার গঠন করতে চায়।

বিএনপির মতে, ফ্যাসিবাদ পতনের পরবর্তী সময়টি ছিল নির্বাচনের প্রস্তুতির সময়, কোনো দীর্ঘমেয়াদি সরকার গঠনের নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ ছিল প্রয়োজনীয় কিছু মৌলিক সংস্কার সম্পন্ন করে দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করা। দলটির মতে, দীর্ঘদিনের কর্তৃত্ববাদী শাসনে দেশের প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশনসহ সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে। নির্বাচনের আগে এ অবস্থা আংশিক সংস্কার প্রয়োজন হলেও সেটি দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করে না। বরং দ্রুত নির্বাচন না হলে নতুন করে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হতে পারে।

অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামো একেবারেই ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। দীর্ঘ সাড়ে পনেরো বছরের একক দুঃশাসনের ফলে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, এমনকি অর্থনীতি পর্যন্ত বিপর্যস্ত। বিশিষ্টজনদের মতে, এই অবস্থায় ৫ আগস্টের পরবর্তী প্রেক্ষাপটে সরাসরি রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে একটি জাতীয় সরকার গঠনই হতে পারত সঠিক পথ। তাদের আশঙ্কা, অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাবিহীন হওয়ায় সংকট সমাধানে দুর্বলতা দেখা দিচ্ছে।

চলতি বছরের মে মাসে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি পরিষদ আয়োজিত এক সভাতেও ড. ইউনূসকে রাষ্ট্রপতি এবং তারেক রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করে জাতীয় সরকারের প্রস্তাবও দেওয়া হয়। বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্ট নাগরিকরা তখন বলেন, দেশের জন্য কল্যাণকর শাসনব্যবস্থা গঠনে জাতীয় সরকারই হতে পারে উত্তম পথ। তবে বিএনপি বরাবরই এ ব্যাপারে দ্বিমত জানিয়ে এসেছে।

এ প্রসঙ্গে দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, জাতীয় সরকার গঠনের চেয়ে জনগণের ম্যান্ডেটই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জনগণ ছাড়া কোনো সরকার তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ১৫-২০ বছর ধরে নতুন প্রজন্ম ভোট দিতে পারেনি- এটা বড় সংকট। তাই প্রথম কাজ হওয়া উচিত নির্বাচন, তারপর জাতীয় সরকার।

দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও একাধিকবার বলেছেন, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করেই ভবিষ্যতে একটি জাতীয় সরকার গঠন করবে বিএনপি। তার বক্তব্যে স্পষ্ট, জনগণের ভোটের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে, জাতীয় সরকার গঠনে তাদের সঙ্গে আন্দোলনে শরীক দলগুলোও অংশ নেবে। ইতিহাস টেনে এনে তিনি বলেন, “স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ এককভাবে সরকার গঠন করে বিভক্তির সূচনা করেছিল। সে ভুল পুনরাবৃত্তি বিএনপি করতে চায় না। ”

জাতীয় সরকার প্রশ্নে অতীত অভিজ্ঞতাও বিএনপিকে কিছুটা সতর্ক করে তুলেছে। ১৯৭১ সালের পর সেসময়ের ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান জাতীয় সরকারের প্রস্তাব দিলেও শেখ মুজিবুর রহমান তা গ্রহণ করেননি। ফলে এককভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একইভাবে ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার পর বিশিষ্টজনেরা জাতীয় সরকারের আহ্বান জানিয়েছিলেন, কিন্তু সেবারও তা উপেক্ষিত হয়েছিল। ফলে ওয়ান-ইলেভেনের পর এক অগোছালো নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।

রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেকেই মনে করেন, ৫ আগস্টের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিএনপি যদি সত্যিই জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে থাকে, তবে তা রাজনৈতিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলেও ভবিষ্যতে এর খেসারত দিতে হতে পারে। কারণ পরিবর্তনের প্রত্যাশায় থাকা জনগণ ও আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন মনে করেন, “দেশের সংকট নিরসনে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়াই এখন সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সেখানে যদি ব্যর্থতা আসে, গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রত্যাশা মুখ থুবড়ে পড়বে। ”

সব মিলিয়ে, জাতীয় সরকার ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান মূলত নির্বাচনের আগে নয়, নির্বাচনের পর। তারা মনে করে, জনগণের ভোট ছাড়া কোনো সরকার গ্রহণযোগ্য নয়। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতনের পরও গণতন্ত্রের পথে ফেরার প্রধান সেতু হতে হবে নির্বাচন- এই বিশ্বাসেই তারা জাতীয় সরকারে রাজি হয়নি।

অন্যদিকে, দেশের বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পুনরায় উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অর্থনীতি এবং গণতান্ত্রিক চর্চার প্রশ্নে বহু প্রশ্ন উঠছে সরকারের সক্ষমতা নিয়ে। অনেকেই বলছেন, সরকার ব্যর্থ হলে বা যদি পরিস্থিতি আরও জটিল হয়, তবে ভবিষ্যতে জাতীয় সরকার আবারো আলোচনায় আসতে পারে।

রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জাতীয় সরকার গঠন হোক বা নির্বাচন, উভয়ের পেছনেই রয়েছে দেশের মানুষকে এক নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা। কার পথ সফল হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সংলাপ, ঐকমত্য ও জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়।

এসবিডব্লিউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।