ঢাকা, শনিবার, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ০২ আগস্ট ২০২৫, ০৭ সফর ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

হাসিনাকে পুনর্বাসনের চক্রান্ত

আ.লীগের ৪০০ ক্যাডারের সমাগম কীভাবে সবার চোখ এড়াল?

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:০২, আগস্ট ১, ২০২৫
আ.লীগের ৪০০ ক্যাডারের সমাগম কীভাবে সবার চোখ এড়াল?

ঢাকা: ভারতে পলাতক ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে নতুন করে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠেছে। তাকে দেশে আনার প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য নৈরাজ্য সৃষ্টি করার ছক কষতে গত ৮ জুলাই রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকায় একটি কনভেনশন সেন্টার ভাড়া নিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ৪০০ জন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডারকে জড়ো করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

প্রায় তিন সপ্তাহ পর ওই ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর তোলপাড় চলছে দেশজুড়ে।  

পুলিশ বলছে, কনভেনশন হলটি শামীমা নাসরিন শম্পা নামে একজন ব্যক্তি ভাড়া নেন। সে সময় তিনি বিদেশে লোক পাঠানোর নাম করে একটা প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করেছিলেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হল ভাড়া নেওয়ার সময় মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হলেও এত লোকের সমাগম কীভাবে পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থাসহ সবার নজর এড়াল তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

জানা গেছে, ওই গোপন সমাগম ও প্রশিক্ষণ আয়োজনের মূল হোতা ছিলেন সেনাবাহিনীর মেজর সাদেকুল হক ও তার স্ত্রী পুলিশের সহকারী সুপার (এএসপি) সুমাইয়া জাফরিন। এরই মধ্যে মেজর সাদেকুল হককে হেফাজতে নিয়েছে সেনাবাহিনী।  ঘটনাটির সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে একটি তদন্ত আদালতও গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তদন্ত শেষ হলে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।

আরও পড়ুন: ১৫০ দিন কোথায় ‘গায়েব ছিলেন’ মেজর সাদেক দম্পতি?

নিরাপত্তা ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজধানীতে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের জনভিত্তিক নজরদারির মধ্যে থেকেও এই ধরনের একটি বড় পরিসরের কার্যক্রম কোনো নিরাপত্তা সংস্থা, ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ কর্মশালা ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলমান থাকলেও সেদিনও কেউ জানতে পারেনি, এটা অবিশ্বাস্যই ঠেকছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, যদি সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি জানাত, তাহলে সেই কনভেনশন সেন্টার ঘিরে উপস্থিত থাকা সবাইকেই আইনগত প্রক্রিয়ায় আনা সম্ভব হতো।  

রাজধানীতে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও এমন একটি গোপন প্রশিক্ষণ কীভাবে আয়োজন হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতেও।

বিষয়টি নিয়ে একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, এমন একটি স্পর্শকাতর কার্যক্রম কোনো বাহিনীর তৎক্ষণিক গোচরে না আসা সত্যিই দুঃখজনক।  

তিনি বলেন, রাজধানীজুড়ে এলাকাভিত্তিক সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে সিটি এসবি (নগরে দায়িত্বরত স্পেশাল ব্রাঞ্চ), র‌্যাবসহ সরকারের আরও গোয়েন্দা সংস্থা ডিউটি করে থাকে। শুধু ঢাকাতেই একটি গোয়েন্দা বিভাগের আনুমানিক ৫১টি জোন আছে। একেকটি জোনে ৬-৮ জনের টিম থাকে, যাদের একজন কর্মকর্তা নিয়ন্ত্রণ করেন। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা তাদের তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। আর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় থাকলে তো তাদের ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। জোনভিত্তিক দায়িত্বে থাকা গোয়েন্দা সদস্যরা প্রতিদিনের তথ্য সংগ্রহ করে কর্মকর্তাদের দিয়ে থাকেন।

ওই কর্মকর্তা বলেন, ঢাকার নামকরা কনভেনশন সেন্টারটি অগ্রিম ভাড়া নিয়েছে, সেখানে কতজন লোক, কোন ব্যানারে অনুষ্ঠান করবে, এটা আগের দিনই গোয়েন্দাদের তথ্য দেওয়ার কথা। পাশাপাশি অনুষ্ঠানের দিন সেই কনভেনশন সেন্টারে কতজন লোক হয়েছে, কারা অনুষ্ঠান করছে, অনুষ্ঠানের দিন উপস্থিত থাকা লোকজন ও নেতারা কী কী কথা বলছে, এসব তুলে ধরার কাজও গোয়েন্দাদের। মিথ্যা তথ্য দিয়ে সেই কনভেনশন সেন্টার ভাড়া নিল, কিন্তু এতগুলো লোক সেই কনভেনশন সেন্টারে জড়ো হল, তখনো গোয়েন্দাদের টনক নড়েনি যে ভেতরে কী হচ্ছে!

তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, একটি গলির ভেতরে কোনো ছিনতাইকারী একজনকে গুলি করে চলে গেল, সেটা তাৎক্ষণিকভাবে নাও জানতে পারেন গোয়েন্দারা। কিন্তু এটা তো একটা কনভেনশন সেন্টারে ভাড়া নিয়ে দিনভর প্রোগ্রাম হয়েছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে পুনর্বাসনে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি কীভাবে করা যায়, তার প্রশিক্ষণ নিল এতগুলো লোক। অথচ তাৎক্ষণিকভাবে কোনো গোয়েন্দা জানলো না।  

প্রশিক্ষণের চার দিন পর ধরা কনভেনশন সেন্টার ভাড়া নেওয়া শম্পা
৮ জুলাই আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর গত ১২ জুলাই উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকার ১১ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর রোডের ৮৩ নম্বর বাসা থেকে বরগুনার যুবলীগ নেতা সোহেল রানা ও একই সেক্টরের ১০/বি রোডের ১০ নম্বর বাসা থেকে গোপালগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেত্রী শামীমা নাসরিন শম্পাকে গ্রেপ্তার করে ভাটারা থানা পুলিশ। শম্পার স্বামী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এছাড়া মেহেরপুরের যুবলীগ আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান রিটনকেও গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের তিনজনের বিরুদ্ধে এসব প্রশিক্ষণে সার্বিক সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে।

শুধু ভাটারা থানা এলাকায় নয়, রাজধানীর পূর্বাচলের সি-সেল রিসোর্টে, কাঁটাবনে এবং মিরপুর এলাকায়ও তিনটি প্রশিক্ষণের তথ্য পাওয়া যায়। এসব প্রশিক্ষণে আওয়ামী ক্যাডারদের সশস্ত্র ও ভার্চুয়াল লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাতে ঢাকায় তিন থেকে চার লাখ নেতাকর্মীর সমাগম ঘটিয়ে বিমানবন্দর ও শাহবাগ দখলের পরিকল্পনা ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গ্রেপ্তার সোহেল রানা ও শামীমা নাসরিন শম্পাকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়ে মুখোমুুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে বেরিয়ে আসে মেজর সাদেকুল হক সাদেকের নাম, যিনি এসব প্রশিক্ষণে মূল সমন্বয়ের কাজ করেন। তার সঙ্গে এই নীলনকশায় জড়িত স্ত্রী এএসপি সুমাইয়া জাফরিন।  

এসবির সতর্কবার্তা
নাশকতার এসব প্রশিক্ষণ ও চক্রান্তের মধ্যে গত সোমবার (২৮ জুলাই) সারাদেশে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে একটি বিশেষ সতর্কবার্তা পাঠায় স্পেশাল ব্রাঞ্চ-এসবি। এতে দেশের সব জেলার পুলিশ সুপারদের একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ঐতিহাসিক জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি ঘিরে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও ফ্যাসিবাদবিরোধী সামাজিক সংগঠনগুলো ১ জুলাই থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। এই ধারাবাহিকতায় ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সময়কে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এতে বলা হয়, এই সময়ে ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো দেশব্যাপী অনলাইন ও অফলাইনে উসকানিমূলক প্রচারণা চালিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে। পাশাপাশি ফ্যাসিবাদবিরোধী কর্মসূচিতে বাধা দিয়ে বা উসকানি সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অপচেষ্টাও হতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে দেশের সব ইউনিটকে নিজ নিজ এলাকায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও যানবাহনের ওপর নজরদারি, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার এবং সাইবার গোয়েন্দা কার্যক্রম তীব্র করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত বিশেষ অভিযান চালাতে বলা হয়েছে।  

‘গুরুত্ব দিয়ে’ তদন্ত করছে পুলিশ
এদিকে ডিএমপি বলছে, রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকায় আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ বৈঠকের রহস্য উদঘাটনে এবং এর পেছনে জড়িতদের বের করতে ‘গুরুত্ব দিয়ে’ তদন্ত করা হচ্ছে। একইসঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থান ও অন্তর্বর্তী সরকারের বর্ষপূর্তিতে আগস্ট ঘিরে নানা হুমকির বিষয়ে আলোচনার মধ্যে পুলিশ বলছে, আগস্টকেন্দ্রিক কোনো ধরনের নিরাপত্তা শঙ্কা নেই।

শুক্রবার (১ আগস্ট) বিকেলে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান আরও বলেন, গত ৮ জুলাই ভাটারা থানা এলাকার একটি কনভেনশন সেন্টারে ‘গোপন বৈঠক’ করায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের ২২ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।  

বৈঠকের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তালেবুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গত ৮ জুলাই ভাটারা থানা এলাকায় এক কনভেনশন হলে একটা বৈঠক নিয়ে আমাদের কাছে তথ্য ছিল। কনভেনশন হলটি শামীমা নাসরিন শম্পা নামে একজন ব্যক্তি ভাড়া নেন। সে সময় তিনি বিদেশে লোক পাঠানোর নাম করে একটা প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করেছিলেন। যেখানে ‘ষড়যন্ত্রমূলকভাবে’ লোকজনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যার প্রেক্ষিতে গত ১৩ জুলাই ভাটারা থানায় একটি মামলা করা হয়।

তালেবুর রহমান বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে ইতোমধ্যে ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে দেখছি। এ ঘটনার অন্য কোনো দিক আছে কি না, এর প্রকৃত রহস্য কী এবং কারা কারা এর পেছনে দায়ী? ঘটনার সঙ্গে কারা কারা জড়িত শিগগিরই উন্মোচন করার আশা করছি।  

এজেডএস/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।