ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ আষাঢ় ১৪৩২, ০৮ জুলাই ২০২৫, ১২ মহররম ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

নির্বাচন পেছাতে পিআর, ফেব্রুয়ারি নিয়ে সংশয় বিএনপির 

সিফাত বিনতে ওয়াহিদ ও ইফফাত শরীফ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০:০৪, জুলাই ৮, ২০২৫
নির্বাচন পেছাতে পিআর, ফেব্রুয়ারি নিয়ে সংশয় বিএনপির 

বহুল আলোচিত লন্ডন বৈঠকের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে যে আশাবাদের আলো জ্বলেছিল, কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে সেই আলো যেন নিভু নিভু করছে। বিএনপিতে দেখা দিয়েছে সন্দেহ-সংশয়ের ঘনঘটা।

দলটির নেতারা মনে করছেন, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কার্যক্রমে লন্ডন বৈঠকের কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। বরং সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিসহ কিছু নতুন ইস্যু সামনে এনে জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করার কৌশল নেওয়া হচ্ছে।

বিএনপির নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, গত ১৩ জুন লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ ও প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার বিষয়ে যে ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল, বাস্তবে এখনো তার কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়।  

দলীয় সূত্র বলছে, ইসির কার্যক্রমে লন্ডন বৈঠকের প্রতিফলন অনুপস্থিত। সেই সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন ও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির দাবি সামনে আনার ঘটনাকে ‘নির্বাচন বিলম্বিত করার কৌশল’ হিসেবে দেখছে দলটির হাইকমান্ড।

জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার বিশেষ করে সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে কয়েকটি দল। এ প্রেক্ষাপটে গত ২৬ জুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীনের ‘ওয়ান টু ওয়ান’ বৈঠকে রাজনৈতিক মহলে নতুন করে আলোচনা তৈরি করেছে। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা আশা করেছিলেন, এই বৈঠকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত বা দিকনির্দেশনা আসবে, তবে সরকারি ভাষ্যে তা শুধুই ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’। এ বিষয়ে ইসিও কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেননি।

এখন পর্যন্ত নির্বাচনকেন্দ্রিক রোডম্যাপ বা স্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা না দেখা যাওয়ার মধ্যে কয়েকটি দলের পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি ক্রমশই রাজনীতির মাঠ ঘোলাটে করছে। এতে জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন রাজনীতিবিদসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। পিআর পদ্ধতি আসলে কী? কেন এই পদ্ধতিকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ দেখা দিচ্ছে? কিংবা কেন নির্বাচনের ভবিষ্যৎ নিয়েই সৃষ্টি হচ্ছে অনিশ্চয়তা? বিএনপির ওপর চাপ তৈরির কৌশল হিসেবেই কি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাইছে অন্যান্য দলগুলো—এসব বিষয়ে চলছে নানামাত্রিক বিশ্লেষণ।

সংশ্লিষ্টদের মতে, পিআর পদ্ধতিতে মূলত আসনভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে না। ভোটাররা সরাসরি কোনো প্রার্থীকে নয়, ভোট দেন রাজনৈতিক দলকে। একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সেই অনুপাতে জাতীয় সংসদে তাদের আসন বরাদ্দ হয়। বিশ্বের প্রায় ৯১টি দেশে এ ধরনের পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল ও শ্রীলঙ্কাও এই পদ্ধতি অনুসরণ করে। আবার কিছু দেশে সরাসরি ভোট ও অনুপাতিক পদ্ধতির সমন্বয়ে মিশ্র পদ্ধতি চালু রয়েছে।  

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যদিও পদ্ধতির মূল ধারণা একই, বাস্তবে দেশ ভেদে এর প্রয়োগে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। অনেক দেশে দলভিত্তিক মনোনয়নপ্রাপ্তদের তালিকা থেকেই সংসদ নির্বাচন করা হয়। অর্থাৎ ব্যক্তি নয়, বরং রাজনৈতিক দলই হয় মূল প্রতিযোগী।

সহজ ভাষায় বললে, এ পদ্ধতিতে ভোটের হারই নির্ধারণ করে আসনের সংখ্যা। যেমন, বাংলাদেশে যদি কোনো দল মোট গৃহীত ভোটের ১০ শতাংশ পায়, তাহলে সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে তাদের জন্য বরাদ্দ হবে ৩০টি আসন। ১ শতাংশ ভোট পেলে আসন পাবে ৩টি। এই বাস্তবতা নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে- বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই পদ্ধতি কতটা কার্যকর কিংবা গ্রহণযোগ্য?

বিএনপি ও সমমনা ছয়টি দল ও জোট এ পদ্ধতির বিরোধিতা করছে। অন্যদিকে, এ পদ্ধতিতে নির্বাচন ও আসন বণ্টনের দাবিতে সরব জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। যদিও এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ এবং এবি পার্টি সরাসরি এই পদ্ধতির পক্ষে অবস্থান নেয়নি, তবু এই দাবিকে তারা প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়ে আসছে।  

দলীয় সূত্রগুলো বলছে, প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষে ভোটভিত্তিক আসন বণ্টনের প্রস্তাবে বিএনপিকে সম্মত করাতে এই দাবিকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

সংস্কার সংলাপকে ঘিরে রাজনৈতিক দরকষাকষির অংশ হিসেবে এই দলগুলো সংসদের প্রচলিত আসনভিত্তিক নির্বাচনের পরিবর্তে পিআর পদ্ধতির দাবি সামনে এনেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মোট ভোটের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টনের প্রস্তাব বিএনপি মেনে নিলে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ অন্যান্য দল নিম্নকক্ষে পিআর পদ্ধতির দাবিতে নমনীয় অবস্থান নিতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে আনুপাতিক ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠনের নিশ্চয়তা না পেলে এসব দল নির্বাচনে না যাওয়ার কিংবা বর্জনের হুমকি দেওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

এমন অবস্থায় পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দেশে ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তিমূলক সমাজ এবং অস্থিতিশীল সরকার সৃষ্টির কারণ হয়ে উঠতে পারে কিনা তা ভেবে দেখতে সব রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

১ জুলাই বিএনপি আয়োজিত ‘গণঅভ্যুত্থান ২০২৪: জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, এই নির্বাচন পদ্ধতির আড়ালে দেশের রাজনীতিতে সবার অগোচরে আবার পরাজিত অপশক্তির পুনর্বাসনের পথ সুগম করে দেওয়া হচ্ছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ মনে করেন, নির্বাচন বিলম্বিত বা না হওয়ার জন্য পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাওয়া হচ্ছে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘পিআর পদ্ধতিতে যারা নির্বাচন আয়োজনের দাবি তুলছেন অথবা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাচ্ছেন, তাদের অবস্থান উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। হয় তারা জাতীয় নির্বাচন পেছাতে চাইছেন, নাহয় চাইছেনই না নির্বাচন হোক। ’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, পিআর পদ্ধতির প্রচলন হলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। এর ফলে দেশে কোনো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকবে না।  

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, ‘এতে ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন হওয়ার আশঙ্কা থাকে, যার ফলে বিদেশিরা প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পাবে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ’

যদিও পিআর ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতি মেনে নিতে নারাজ জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের মতে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি চালু হলে কেউ একক কর্তৃত্ব কায়েম করতে পারবে না। পিআর পদ্ধতির পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘এই পদ্ধতিতে ভোট ডাকাতির সুযোগ নেই। এছাড়া পদ্ধতিগত পরিবর্তন ছাড়া দেশে গণতন্ত্র ও ন্যায়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয়। ’

৫ জুলাই ফেনীতে আয়োজিত জামায়াতের রুকন সম্মেলনে দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘ফ্যাসিজম তৈরির পথ বন্ধ করতে হলে পিআর পদ্ধতিকে বেছে নিতে হবে। ’ 

এ সময় তিনি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনের কথাও বলেন। এ ছাড়া পরবর্তী নির্বাচনগুলোও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

তারও আগে ২৮ জুন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতৃত্বে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত মহাসমাবেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং পিআর পদ্ধতির দাবিতে কথা বলেন ২৩টি রাজনৈতিক দলের নেতারা। তবে এই মহাসমাবেশে বিএনপির কোনো প্রতিনিধিকে দেখা যায়নি। আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিএনপি পিআর ব্যবস্থার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। বিএনপি এটিকে পরিকল্পিতভাবে কোণঠাসা করার চেষ্টা হিসেবেই দেখছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও লন্ডন বৈঠকের পর তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও প্রধান উপদেষ্টা দেশে ফেরার পর সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচনের কোনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না দেওয়ায় নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে।

অবশ্য সোমবার সিলেট সফরে গিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসেই জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করবে অন্তর্বর্তী সরকার, এমন প্রত্যাশা তার।

তিনি বলেন, নির্বাচন যত দেরি হবে, দেশ তত পিছিয়ে যাবে দেশ পিছিয়ে গেলে বিনিয়োগ আসবে না, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, নারীরা নিরাপত্তা হারাবে, জুডিশিয়াল ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। সেজন্য দরকার একটা নির্বাচিত সরকার।

এসবিডব্লিউ/ইএসএস/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।