ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ আষাঢ় ১৪৩২, ২৪ জুন ২০২৫, ২৭ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ফেরারি আওয়ামী লীগ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:৩৩, জুন ২৩, ২০২৫
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ফেরারি আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এখন পরিত্যক্ত ভবন | সংগৃহীত ছবি

ছাত্র-জনতার ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এখন চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। নিষিদ্ধ রয়েছে দলটির যাবতীয় কার্যক্রম।

নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী দলটি।

আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বড় একটি অংশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পলাতক রয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দি রয়েছেন শীর্ষ পর্যায়ের বহু নেতা ও তাদের সরকারের সাবেক মন্ত্রী-এমপিরা। বিদেশে পাড়ি জমানো আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, বেলজিয়াম, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। তবে অধিকাংশ নেতা পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। তারা দিল্লি, কলকাতা, শিলং, আগরতলা, শিলিগুড়িসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে অবস্থান করছেন।

ভারতে পালিয়ে যাওয়া নেতাকর্মীদের মধ্যে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও রয়েছেন। দেশে রয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের নেতাকার্মীরা হয় আত্মগোপনে রয়েছেন, নয় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তৃণমূলের কোনো কোনো কর্মী মাঝেমধ্যে ঝটিকা মিছিল করলেও পুলিশ ভিডিও দেখে পরবর্তীতে তাদের আটক করছে।

শুধু তাই নয়, আইন সংশোধনের পর ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের মুখে রয়েছে দলটি। অথচ মুক্তিযুদ্ধসহ এই দলের রয়েছে বর্ণাঢ্য ইতিহাস। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে বিরোধীদের ওপর ব্যাপক দমনপীড়ন, গুম, খুন, নির্যাতন এবং সবশেষ গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালায় আওয়ামী লীগ।

এর ফলে দলটির যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং নিবন্ধন স্থগিত করায় এখন তাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, নির্বাচনে তারা (আওয়ামী লীগ) থাকবে কি না, সেটা নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।

এদিকে বেশ কিছু দিন ধরে দলের বর্তমান নেতৃত্বকে বাদ দিয়ে একটি রিফাইন্ড বা পরিশুদ্ধ আওয়ামী লীগের আলোচনা সামনে এসেছে। যদিও এটাকে দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে মনে করছিল আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে দলের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের মূল নেতৃত্বকে মাইনাস করা বা বাদ দেওয়াই এর উদ্দেশ্য বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের এই বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির এক নেতা বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আওয়ামী লীগ অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে অগ্রসর হয়েছে। আওয়ামী লীগের পথ চলা অধিকাংশ সময়ই প্রতিকুল ছিল বলা যায়। প্রতিকূলতা পেরিয়েই বাংলাদেশের অর্জন ও সফলতা আওয়ামী লীগের হাত ধরে এসেছে। যদিও বর্তমান সময়ের বিপর্যয় দলের ইতিহাসের অনেক কঠিন ও বড় বিপর্যয়। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের মানুষের দল। এ বিপর্যয় কাটিয়ে আওয়ামী লীগ আবারও এদেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাবে।

যেভাবে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ
গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ। জনরোষের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান দলটির প্রধান শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের হিসাব মতে, ওই অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হাসিনার নির্দেশে নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলাসহ সহিংসতায় এক হাজার চারশ’ জন নিহত হয়। আহত হয় হাজার হাজার মানুষ। যাদের মধ্যে কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, কেউ হারিয়েছেন চোখের আলো।

৫ আগস্টের পর মূলত আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছিল ছাত্র-জনতা। এর মধ্যে ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে সরকার। কিন্তু আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করায় ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন চালিয়ে এসেছে ছাত্র-জনতা। সবশেষ গত মে মাসের শুরুর দিকে এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর ডাকে অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়।

এতে হাসনাতের দল এনসিপির পাশাপাশি যোগ দেয় জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, আপ বাংলাদেশ, জুলাই ঐক্য, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থী, ইনকিলাব মঞ্চসহ গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের নেতা-কর্মীরা। এর বাইরে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরাও অংশ নেন।

৯ মে শুক্রবার সকালে ওই কর্মসূচি থেকে জুমার নামাজের পর বড় সমাবেশের ঘোষণা দেন হাসনাত আবদুল্লাহ। এজন্য যমুনা ভবনের পাশেই মিন্টো রোড সংলগ্ন ফোয়ারার কাছে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়। বিকেলে সেখানে সমাবেশ শেষে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ অবরোধ করেন। ওই কর্মসূচিতে ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীসহ আরও কিছু রাজনৈতিক দল ও সংগঠন যোগ দেয়। হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত কর্মসূচি থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হয়।

১০ মে শনিবার রাতে ওই আলটিমেটাম শেষ হলে আন্দোলনকারীরা আবার শাহবাগ ছেড়ে যমুনার অদূরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। এর আগে রাত ৮টার পর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ বিশেষ বৈঠকে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। ১২ মে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। সেই সময়ের কথা উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২০০৯ সালে ৬ জানুয়ারি সরকার গঠনের পর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্য ও ভিন্নমতের মানুষের ওপর হামলা, গুম, খুন, হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণসহ বিভিন্ন নিপীড়নমূলক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর দলটির ভূমিকা উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের বিরুদ্ধে গত বছরের ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে গুম, খুন, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, গণহত্যা, বেআইনি আটক, অমানবিক নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, সন্ত্রাসী কার্য ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে এবং এসব অভিযোগ দেশি ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এসব অপরাধে দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা বিচারাধীন রয়েছে উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, এসব মামলার বিচারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, বাংলাদেশের সংহতি, জননিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার লক্ষ্যে গত ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন কর্তৃক গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, উসকানিমূলক মিছিল আয়োজন, রাষ্ট্রবিরোধী লিফলেট বিতরণ এবং ভিনদেশে পলাতক তাদের নেত্রীসহ অন্য নেতাকর্মী কর্তৃক সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অপরাধমূলক বক্তব্য প্রদান, ব্যক্তি ও প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের প্রচেষ্টাসহ আইন-শৃঙ্খলা বিরোধী কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হয়েছে।

এসব কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে, দলটি এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার বাদী ও সাক্ষীদের মনে ভীতির সঞ্চার করা হয়েছে ও এভাবে বিচার বিঘ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং সার্বিকভাবে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকাসহ জনমনে ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসী সংগঠনের ন্যায় বিভিন্ন বেআইনি কার্যকলাপ ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।

এসব কারণে আইন অনুসারে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন কর্তৃক যে কোনো ধরনের প্রকাশনা, গণমাধ্যম, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে কোনো ধরনের প্রচারণা, মিছিল, সভা-সমাবেশ, সম্মেলন আয়োজনসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো’, প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।

যেভাবে বিচারের পথ খুলল
১০ মে রাত ৮টার পর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠক শুরু হয়, যা রাত ১০টা পর্যন্ত চলে। বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। সেখানে বলা হয়, উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে।

উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেস-সহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এরপর রাতেই আইন সংশোধনের গেজেট প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত গেজেটে বলা হয়েছে, সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (দ্বিতীয় সংশোধনী) অর্ডিন্যান্স, ২০২৫ প্রণয়ন ও জারি করেছেন।

সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে, সংগঠন অর্থাৎ কোনো রাজনৈতিক দল, অথবা সেই দলের অধীনস্থ, সংশ্লিষ্ট বা সহযোগী কোনো সত্তা, অথবা এমন কোনো ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে বোঝায় যা ট্রাইব্যুনালের অভিমত অনুযায়ী, ওই দল বা সত্তার কার্যকলাপ প্রচার, সমর্থন, অনুমোদন, সহায়তা বা সম্পৃক্ততার মাধ্যমে জড়িত থাকে।

সংগঠনের জন্য শাস্তি ইত্যাদি বিষয়ে বলা হয়েছে, এই আইনের বা তৎকালীন প্রযোজ্য অন্য কোনো আইনে যাই থাকুক না, যদি ট্রাইব্যুনালের কাছে প্রতীয়মান হয় যে কোনো সংগঠন এই আইনের ৩ ধারার উপ-ধারা (২) অনুযায়ী উল্লিখিত অপরাধসমূহ করেছে, নির্দেশ দিয়েছে, চেষ্টা করেছে, সহায়তা করেছে, প্ররোচিত করেছে, উসকানি দিয়েছে, ষড়যন্ত্র করেছে, সহজতর করেছে বা সহযোগিতা করেছে, তাহলে ট্রাইব্যুনাল সেই সংগঠনের কার্যক্রম স্থগিত বা নিষিদ্ধ করার, সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণার, তার নিবন্ধন বা লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করার এবং তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা রাখবে।

গেজেট জারির পর এ বিষয়ে প্রসিকিউটর (প্রশাসন) গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম বলেন, ১৯৭৩ সালে আইন প্রণয়নের পর ২০১৩ সালে তৎকালীন সরকার সংশোধন করে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনেরও বিচারের ব্যবস্থা করে। তবে আইনে সংগঠনের শাস্তির কোনো ব্যবস্থা না থাকায় গতকাল সরকার সংশোধন করে সংগঠনের শাস্তির বিধান যুক্ত করে।

তিনি বলেন, এ সংশোধনীর পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের বিরুদ্ধে তদন্ত, বিচারকাজ পরিচালনা এবং শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রসিকিউশনের পক্ষে মনে করি, এটা যথোপযোগী উদ্যোগ। যদিও প্রচলিত অন্যান্য আইনেও সংগঠন নিষিদ্ধ করার বিধান আছে। তারপরেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মতো একটি স্ট্যান্ডার্ড আইন বা ট্রাইব্যুনালে ব্যক্তি বা সংগঠনের বিচার যদি হয়ে থাকে, এটি হবে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য।

আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত
১২ মে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯–এর ধারা-১৮(১)–এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের যেকোনো ধরনের প্রকাশনা, গণমাধ্যম, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেকোনো ধরনের প্রচারণা, মিছিল, সভা-সমাবেশ, সম্মেলন আয়োজনসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, সেহেতু বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করল।

আওয়ামী লীগের শুরু যেখানে
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরনো ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম নিয়ে দলটির প্রতিষ্ঠা হয়। তখন মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদের একটি অংশ বেরিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে নতুন এ দল গঠন করেন।

সাম্প্রদায়িকতার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ পূর্ব পাকিস্তানে (পূর্ব বাংলা) শুরু থেকেই অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চিন্তার প্রসার ঘটতে থাকে। তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসা আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার প্রায় ছয় বছর পর ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ নামে বাঙালির অধিকার আদায়ের লড়াই সংগ্রমের ব্রত নিয়ে এ রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সম্মেলনে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি বর্ষীয়ান নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক তরুণ নেতা শামসুল হক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রথম কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক। নেতৃত্বের ধারাবাহিকতার এক পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন। ১৯৬৬ সালের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পান এবং সভাপতি নির্বাচিত হন। শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ নীতির ওপর ভিত্তি করে আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রসর হতে থাকে। এই অসাম্প্রদায়িক নীতিই হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের মুল চেতনা। আওয়ামী লীগের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিযে শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভুষিত হন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানের শাসন-শোষণ, নির্যাতন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, সামিরক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের সব আন্দোলন এক পর্যায়ে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পথ ধরে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম এগিয়ে যায়। ৬৬’র ৬ দফা আন্দোলন, এরপর ১১ দফার ভিত্তিতে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতার সংগ্রাম, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানি শাসন আমলে এবং স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সময়ে দেশে একের পর এক সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা ছিল দলটির।

৭৬ বছরের মধ্যে প্রায় ৫০ বছরই আওয়ামী লীগকে থাকতে হয়েছে রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে, আন্দোলন-সংগ্রামে। ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করলেও তা বেশি দিন টেকেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের সাড়ে তিন বছর এবং ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৫ বছর এবং ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের  ৫ আগস্ট সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়। বর্তমানে দলটি কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়ে ফেরারি দশায় রয়েছে!

এসকে/ইএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।