ঢাকা, শনিবার, ৮ আষাঢ় ১৪৩২, ২১ জুন ২০২৫, ২৪ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

করোনার নতুন ধরন: আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা

রেজাউল করিম রাজা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩:৫৮, জুন ২০, ২০২৫
করোনার নতুন ধরন: আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা

ঢাকা: ২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ রূপ দেখেছিল সারা বিশ্ব। পাঁচ বছরের ব্যবধানে করোনা ভাইরাস ফের নতুন রূপে ফিরে এসেছে।

ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ বাড়ছে। পাশাপাশি ভাইরাসটির নতুন সাব ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশেও ইতোমধ্যে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়ছে দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ।

রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন, ২০২০ সালের শুরুতে করোনা মহামারি দেখা দেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ভাইরাসটি মিউটেশনের মাধ্যমে (জিনগত উপাদানের পরিবর্তন-জিনোম) একাধিক উপধরন ছড়িয়েছে। যেগুলোর কোনো কোনোটি অনেক শক্তিশালী হওয়ায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হারও বেড়েছে।

বর্তমানে করোনার নতুন যে উপধরন সংক্রমণ বাড়াচ্ছে, সেটির সংক্রামিত করার ক্ষমতা অনেক বেশি হলেও এতে রোগেও তীব্রতা কম। করোনার নতুন এ ধরনটি প্রাণঘাতী না হলেও অসাবধানতা ও অচেতনতায় ধরনটি যেকোনো সময় শক্তিশালীও হয়ে উঠতে পারে। তাই যথেষ্ট সতর্ক ও সচেতনতা আবশ্যক।

গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ছয়জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। চলতি বছরে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৩৯৩ জনের। যার মধ্যে চলতি মাসের ২০ দিনেই শনাক্ত হয়েছেন ২৩৫ জন। এ যাবৎ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ২০ লাখ ৫১ হাজার ৯৩৮ জন।     

গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা যায়নি। চলতি বছরে সাতজন করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এই সাতজনই জুন মাসের ২০ দিনে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এ যাবৎ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৯ হাজার ৫০৬ জন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালসহ সারাদেশেই করোনা পরীক্ষার কিটের স্বল্পতা রয়েছে। কিটের স্বল্পতা না থাকলে আরও বেশি করোনা পরীক্ষা করা গেলে শনাক্তের হারও বাড়বে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বর্তমান উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, বাংলাদেশসহ থাইল্যান্ড, চীন ও ভারতেও করোনার কিছু নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হচ্ছে। যেগুলো দ্রুত সংক্রমিত করতে পারে। তবে বর্তমানে পাওয়া যাওয়া উপধরনগুলো আগের মতো প্রাণঘাতী নয়। সাধারণ জ্বর, সর্দি বা মৌসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মতো। কিন্তু এখন থেকেই স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে গুরুত্ব না দিলে এটি আরও বাড়তে পারে। সংক্রমণ বাড়লে মৃত্যুও বাড়বে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইইডিসিআর) পরিচালিত সর্বশেষ কোভিড-১৯ সার্ভিলেন্স ‘ন্যাশনাল ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভিলেন্স ও পিএইচওসি’ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের মে থেকে দেশে করোনা সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে শুরু করেছে।

গেল মাসে ১ হাজার ৪০৯ জন সম্ভাব্য কোভিড-১৯ রোগীর নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ১৩৪ জন পজিটিভ শনাক্ত হন, যা পরীক্ষার ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ। এটি ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মে সময়কালে সর্বোচ্চ হার। এর আগে ২০২৩ সালের মে-আগস্ট এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারি-আগস্টে সংক্রমণের হার ছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি। সর্বশেষ পাওয়া নমুনাগুলোর জিনোম সিকুয়েন্সিং করে ‘ওমিক্রন বিএ ২.৮৬’ ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে, যা এর আগেও দেশে শনাক্ত হয়েছিল।

আইসিডিডিআর,বি চলতি বছর সংক্রমণ বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে নতুন দুটি সাব-ভ্যারিয়েন্ট এক্সএফজি ও এক্সএফসি বাড়ার তথ্য তুলে ধরে। চলতি জুনের প্রথম ১০ দিনে ১৪টি জিনোম সিকুয়েন্স করা হয়। এর মধ্যে ১২টিতেই এ ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে, যা ওমিক্রন জেএন.১-এর একটি উপশাখা। সম্প্রতি যেসব নমুনা পাওয়া যাচ্ছে, এর প্রায় সবকটিতে এক্সএফজি ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে।

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ইতোমধ্যে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১১টি নির্দেশনা দিয়েছে।

সংক্রমণ প্রতিরোধে জনসাধারণের করণীয়
১. জনসমাগম যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন এবং উপস্থিত হতেই হলে সেক্ষেত্রে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করুন।

২. শ্বাসতন্ত্রের রোগসমূহ থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য মাস্ক ব্যবহার করুন।

৩. হাঁচি-কাশির সময় বাহু বা টিস্যু দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখুন।

৪. ব্যবহৃত টিস্যুটি অবিলম্বে ঢাকনা যুক্ত ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ফেলুন।

৫. ঘন ঘন সাবান, পানি কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন (অন্তত ২০ সেকেন্ড)।

৬. অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক, মুখ ধরবেন না।

৭. আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন এবং কমপক্ষে ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন।

সন্দেহজনক রোগীদের ক্ষেত্রে করণীয়
১. জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হলে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বাড়িতে থাকুন।

২. রোগীর নাক-মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করতে বলুন।

৩. রোগীর সেবাদানকারীরাও সতর্কতা হিসেবে মাস্ক ব্যবহার করুন।

৪. প্রয়োজন হলে নিকটস্থ হাসপাতালে অথবা আইইডিসিআর (০১৪০১-১৯৬২৯৩) অথবা স্বাস্থ্য বাতায়ন (১৬২৬৩) এর নম্বরে যোগাযোগ করুন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, করোনা বিষয়ে আমরা যে খুব আতঙ্কগ্রস্ত তা নয়। করোনা এখনও অনেক বেশি পুরোনো রোগ নয়। মহামারিকালে করোনা অদ্ভুত আচরণ করেছে, যেভাবে ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ বদলিয়ে আবির্ভূত হয়েছে এবং সংক্রমণ ঘটিয়েছে সেসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে একেবারের যে ঝুঁকি নেই, অনেক বড় কিছু ঘটবে না এটা বলতে বা মনে করতে চাই না। আমরা বলতে চাই যে করোনা বর্তমানে ঋতুভিত্তিক একটি রোগে পরিণত হয়েছে। এটাকে মোকাবিলায় আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত অনতিবিলম্বে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে থোক বরাদ্দ ও নির্দেশনা দেওয়া। করোনা ও ডেঙ্গু কোনোটাকেই আমরা হালকাভাবে নিতে পারি না। এই রোগ দুটি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। প্রস্তুতি হবে দুটি একটা প্রতিরোধ, আরেকটা কারও রোগ হয়ে গেলে তার চিকিৎসা।

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সদস্য বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে আতঙ্কের বিষয় নেই, তবে সতর্ক থাকতে হবে। করোনা কোনোদিন দেশ থেকে একেবারে চলে যাবে না। এটা সিজন ভেদে সিজনাল ফ্লুর মতো কোথাও হঠাৎ বাড়বে, আবার কমবে। অন্যান্য সিজন ফ্লু যেমন আছে, এটাও তেমনিভাবে পৃথিবীতে থেকে যাবে।

তিনি আরও বলেন, এখন যে ধরনটি আছে, এটা খুব বেশি সংক্রামক হলেও প্রাণঘাতী না। এটা ওমিক্রন ধরনের একটা উপধরন। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে বর্তমানে যে টিকা ও কিট সেটা এদের বিরুদ্ধে প্রয়োগযোগ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ধরনকে ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন হিসেবে বিবেচনা করেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটাকে আন্ডার মনিটরিং বলছে। অর্থাৎ নজরদারিতে রাখতে হবে।  

করোনা প্রতিরোধ বিষয়ে অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, আমাদের উচিত করোনার কোন ভ্যারিয়েন্ট আসছে, সেগুলোর সিকোয়েন্সিংয়ের ব্যবস্থা করা। রোগীদের তাড়াতাড়ি শনাক্তের ব্যবস্থা করতে হবে। সাধারণ করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। অতি ঝুঁকিপূর্ণদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে। তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিনের আরেকটি ডোজ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের হাসপাতাল ও চিকিৎসাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যেন প্রস্তুত থাকে। এটা নিয়ে আমরা যেন আতঙ্ক না ছড়াই।

আরকেআর/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।