ঢাকা, শুক্রবার, ৭ আষাঢ় ১৪৩২, ২০ জুন ২০২৫, ২৩ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

প্রতারণায় ভরপুর জুলাই শহীদ ও আহতদের তালিকা

রেজাউল করিম রাজা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭:৪০, জুন ১৯, ২০২৫
প্রতারণায় ভরপুর জুলাই শহীদ ও আহতদের তালিকা ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দিনের ফাইল ছবি

“জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে জানাচ্ছে যে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের MIS তালিকা প্রস্তুতের প্রক্রিয়াটি যথাযথ স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হয়নি। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাতে চাই যে, আমাদের ফাউন্ডেশনে জমা পড়া ফাইল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে—একাধিক ব্যক্তি জুলাই গণ-আন্দোলনে আহত না হয়েও ভুয়া মেডিক্যাল ডকুমেন্টস ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে MIS ডাটাবেইজে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।

এটি শুধু হতাহতদের প্রতি অবিচার নয়, বরং শহীদদের আত্মত্যাগ ও জাতীয় গণআন্দোলনের প্রতি চরম অবমাননা। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন মনে করে এই প্রক্রিয়া ছিল দুর্বল, অবহেলাপূর্ণ এবং ত্বরিত রাজনৈতিক চাপের ফলে বিকৃত। ”

এ বক্তব্য জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে সরকারের কাছে পাঠানো একটি চিঠির অংশবিশেষ। চিঠির বাক্যগুলো থেকে স্পষ্টতই লক্ষ্য করা যায়, জুলাই শহীদ এবং যোদ্ধাদের সহায়তা ও পুনর্বাসনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে (এমএইএস) যেসব নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেই তালিকায় রয়েছে অসংখ্য ত্রুটি, প্রতারণা এবং জাল-জালিয়াতির আশ্রয়।

জুলাই আন্দোলনে শহীদ ও আহত ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদ, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের প্রমাণপত্র এবং উপযুক্ত অন্যান্য কাগজপত্রসহ সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কার্যালয় অথবা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে গিয়ে সরকারিভাবে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করতে হয়।
গত বছরের ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে যারা শহীদ বা আহত হয়েছেন তাদের নাম এমআইএস তালিকায় তোলার আগে তা যাচাই-বাছাই করে জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন কার্যালয় ও সরকার গঠিত গণ-অভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সেল।

বিভিন্ন মাধ্যমে খোজ নিয়ে জানা যায়, জুলাই অভ্যুত্থানে কোনোভাবে অংশগ্রহণ করেননি, হতাহতও হননি এমন ব্যক্তিদের নামও আছে এমএইএসের তালিকায়।

কেউ আবার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে সেই সময় আহত হননি, পরে কোনো দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন তারাও এমআইএসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। আবার সড়ক বা অন্য কোনো দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তারাও নিজেদের জুলাই যোদ্ধা হিসেবে এমআইএসে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

এমনকি ৫ আগস্টের পরে বন্ধুর ছুরিকাঘাতে মৃত্যু হয়েছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, পারিবারিক কলহের জেরে খুন হয়েছেন, চাঁদাবাজি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন— এমন ব্যক্তিরাও আছেন জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদের তালিকায়।

ইতোমধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে সহায়তা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। জুলাই ফাউন্ডেশনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে এসব প্রতারণার বিষয় চিহ্নিত করেন। ইতোমধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা মো. জাহিদ হোসাইন বাংলানিউজকে বলেন, আমরা যাচাই-বাছাই করে ১৯ জনের নাম এমআইএস তালিকা থেকে বাতিলের জন্য চিঠি দিয়েছি। এ যাবত ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে শহীদ এবং জুলাই আহতদের তালিকায় স্থান পাওয়া প্রায় ৭০ জনের বেশি আমরা শনাক্ত করেছি। এদের বিরুদ্ধে আইনি কার্যক্রম চলমান আছে। আবার অনেকের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছি।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান গ্রাহক সেবা কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমানের শাহবাগ থানায় চলতি বছরের ১৬ এপ্রিলে করা ১১ নম্বর মামলায় দেখা যায়, উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরের মো. ইলিয়াস হোসেন হিরণের বাড়িতে গত বছরের ৭ আগস্ট পূর্ব শত্রুতার জেরে অজ্ঞাতনামা কিছু লোক হামলা করেন। সেই হামলায় তিনি আহত হন। পরে মেডিক্যাল ডকুমেন্টস জালিয়াতির মাধ্যমে নিজেকে জুলাই যোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেন এবং সরকারের কাছ থেকে দুই লাখ টাকার চেক নেন। এ বিষয়ে হিরণ স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন।

একই মামলায় দেখা যায়, ঢাকার মোহাম্মদপুরের জাফরাবাদের মো. লিটন নামের আরেকজন গত বছরের ১৪ জুলাই রাজু ভাস্কর্যের সামনে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে আহত হয়েছেন বলে দাবি করেন। আবার কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় ৭১ হলের সামনে আহত হয়েছেন বলে জানান। প্রকৃতপক্ষে তিনি জুলাই বিপ্লবে আহত হননি। লিটনও প্রতারণা করে জুলাই আহত যোদ্ধা হিসেবে নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেন। জাল কাগজপত্র উপস্থাপন করে লিটন জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে এক লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে (এমআইএস) মো. লিটন এবং ইলিয়াস হোসেন হিরণ দুই জনের নামের তালিকাই ভ্যারিফায়েড দেখা যায়। শুধু লিটন কিংবা হিরণ নয়, জুলাই আহতদের নামের তালিকায় জাল কাগজপত্র উপস্থাপন করে জালিয়াতির মাধ্যমে অনেকেই নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

পাশাপাশি জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদের নামের তালিকাতেও রয়েছে প্রতারণার আশ্রয়। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে যাচাই বাছাইকালে অন্তত চারজন ভুয়া শহীদের তথ্য পাওয়া গেছে।

নোয়াখালী জেলার চাটখিল এলাকার মো. হাবিবুর রহমানের ছেলে মো. ইমতিয়াজ হোসেন। তিনি একটি কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী ছিলেন। ৫ আগস্ট সরকারের পতন হলে তিনি চাটখিল থানা লুট করতে গিয়ে একটি অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যান। পথেই অসাবধানতায় লুটকরা অস্ত্র দিয়ে নিজের পায়েই গুলিবিদ্ধ হন। এরপর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদের নামের তালিকায় ইমতিয়াজও শহীদ হিসেবে স্থান পেয়েছেন। তার গেজেট নম্বর ৭৮৪।

ঢাকার ডেমরা থানার বাহির টেঙ্গা এলাকার মো. সেকেন্দার আলীর ছেলে আবু সাইদ। গত বছরের ৯ আগস্ট শুক্রবার এলাকায় চাঁদাবাজি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হন তিনি। শহীদের নামের তালিকায় আবু সাইদও যুক্ত হয়েছেন। তার গেজেট নম্বর ১৭৯।

এ ছাড়াও যাত্রাবাড়ীতে ১৩ আগস্ট পরাটা আনতে গিয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যান বিজয়। তিনিও আছেন শহীদের তালিকায়।

পুরান ঢাকার ওয়ারী এলাকায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে গুলিতে নিহত হন আল আমিন। অভ্যুত্থানে শহীদের তালিকায় আল আমিনের নামও রয়েছে। তার বাবা ওয়ারী থানায় হত্যা সংক্রান্ত একটি মামলাও করেছেন।

এ বিষয়ে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের গ্রাহক সেবা কর্মকর্তা সাইদুর রহমান শাহিদ বাংলানিউজকে বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময়ে যারাই যেভাবে আহত হয়েছেন, তারা যখন দেখলেন আন্দোলনে আহতদের বাড়তি চিকিৎসা এবং সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, তখন তারাও নিজেদের আহত বলে দাবি করে কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। সে সময়ে অনেক বেশি মানুষ হাসপাতালগুলোতে ভর্তি ছিলেন বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও সেগুলো যাচাই বাচাই করতে পারেনি। যারাই বলেছেন আন্দোলনে আহত তাদেরই এমআইএস করে দিয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা সিভিল সার্জন অফিসে দায়িত্ব দিয়েছিলাম, তাদের জেলায় যারা আহত হয়েছেন এমআইএস হয়নি, তাদের তালিকা করতে। তাদের যাচাই বাছাইয়ের জন্য দুই তিনজন ছাত্র প্রতিনিধিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আসলে তারা কোনো ধরনের যাচাই বাছাই করেনি। যারাই বলেছেন, আমি আন্দোলনে আহত তাদেরই এমআইএস করে দিয়েছে। যে কারণেই ভুয়া আহত এবং ছাত্রদের বিপক্ষে যারা হামলা করতে এসে আহত হয়েছেন তারাও জুলাই আহতদের তালিকায় ঢুকে গেছেন।

শাহিদ আরও বলেন, ফাউন্ডেশনের প্রথম দিকে যেহেতু দ্রুত সময়ে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার অনেক চাপ ছিল, তাই সূক্ষ্মভাবে আমরাও যাচাই করতে পারিনি। তাদের অসহায়ত্ব দেখে আমরা টাকা দিয়ে দিয়েছি। এখন বের হচ্ছে তারা ভুয়া ছিল। বেশ কয়েকজন ভুয়া আহতদের কাছ থেকে টাকা ফেরত নেওয়া হয়েছে, মামলাও দেওয়া হয়েছে। যারা অসচেতনতাবশে এমন করেছেন তাদের আমরা মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছি।

জুলাই ফাউন্ডেশনের এই কর্মকর্তা বলেন, আমি ফাউন্ডেশনে প্রস্তাব দিয়েছি, একটা ফ্রড ডিটেক্টিং টিম করার জন্য, আমরা যাচাই বাছাই করে বের করব, কারা কারা ভুয়া আহত। সিভিল সার্জন অফিসও চাইলে বের করতে পারে কারা ভুয়া আহত। আমরা ফাউন্ডেশন থেকে ১৯ জনের গেজেটও বাতিল করেছি। আন্দোলনে শহীদ হয়নি এমন চার পাঁচজন আমরা পেয়েছি। আমরা যদি ঠিকমতো যাচাই বাছাই করি, সিভিল সার্জন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যদি যাচাই বাছাই করা যায়, তাহলে এখনও এক থেকে দেড় হাজার ভুয়া আহত আমরা বের করতে পারব।

অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের নামের তালিকায় ভুয়া নাম অন্তর্ভুক্ত প্রসঙ্গে গণঅভ্যুত্থান-সংক্রান্ত বিশেষ সেলের দলনেতা (যুগ্মসচিব) মো. মশিউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, শহীদের তালিকা বিষয়ে খুব বেশি আপত্তি নেই, খুব সামান্য আপত্তি আছে। তবে আহতদের তালিকায় বেশ সংখ্যক আপত্তি আছে, মাঝে মধ্যেই এমন অভিযোগ আমাদের কাছে আসে, আমরা সাথে সাথে সেগুলো সংশ্লিষ্ট জেলার ডিসির কাছে পুনরায় যাচাই বাছাইয়ের জন্য পাঠিয়ে দিই।

আরকেআর/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।