ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৩ জুন ২০২৫, ০৬ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা

খাদেমুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৪৯, জুন ১, ২০২৫
রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা পিনাকী ভট্টাচার্য, ইলিয়াস হোসেন ও জুলকারনাইন সায়ের

তথ্য আহরণের জন্য মানুষকে এক সময় ঘাঁটাঘাটি করতে হয়েছে বই। সময়ের বিবর্তনে তথ্যসূত্র হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে জার্নাল।

ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে সংবাদপত্র। সাপ্তাহিক, মাসিক বা পাক্ষিক সংবাদপত্রগুলো সংবাদের পাশাপাশি যোগান দিয়েছে চিত্ত বিনোদনেরও। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন সমাহারও ছিল তাতে। মুদ্রণ শিল্পের বিকাশ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির পর দৈনিক পত্রিকাগুলো হয়ে ওঠে মানুষের তথ্য আহরণের প্রধান উপজীব্য। গত শতকে একক দাপট দেখিয়েছে দৈনিক পত্রিকা। জনমত গঠন ও তথ্য আহরণের প্রধান ক্রীড়নক হয়ে ওঠে সংবাদপত্র।

তবে প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যেতে থাকে চিত্র। ধীরে ধীরে স্যাটেলাইট টেলিভিশনগুলো জনপ্রিয়তা পায়। এরপর কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় সেই টেলিভিশনও দাপট দেখাতে পারেনি বেশি দিন। অনলাইন গণমাধ্যমগুলো বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে দ্রুত সংবাদ নিয়ে হাজির হয়। তাতে মানুষকে পরদিন সংবাদপত্র পাঠ বা সময় করে টেলিভিশনের স্ক্রিনের জন্য আর বসার অপেক্ষা করতে হয়নি। বিশ্বব্যাপী বড় সংবাদপত্র বা টেলিভিশনগুলো অনলাইন মাধ্যমে হাজির হয় সংবাদ নিয়ে।

গল্পটা এখানেই শেষ নয়। গণমাধ্যমকে পাশ কাটিয়ে ইন্টারনেট ভিত্তিক বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে। এক সময় ব্লগে লেখালেখি জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্ম হাজির হলে তথ্যের অবাধ প্রবাহ আরও বেড়ে যায়। মূলধারার গণমাধ্যমকে পাশ কাটিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিভিন্ন তথ্য নিয়ে হাজির হতে থাকে। এমনকি গণমাধ্যমের জন্যও সেই সোর্স সংবাদের খোরাক জোগায়। জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, এমনকি তারকারাও নিজেদের তথ্য সংবাদমাধ্যমের পরিবর্তে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে থাকেন।

তথ্যের এই অবাধ প্রবাহের সুযোগে সংবাদভিত্তিক বিশ্লেষণ বা মতামত নিয়ে হাজির হতে থাকেন অনেকেই। অনলাইন মাধ্যমে তাদের লেখা বা ভিডিও কন্টেন্টগুলো বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থার কারণে মূলধারার গণমাধ্যমগুলো অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেনি। দুর্বল গণমাধ্যমের সুযোগে সেসময় কন্টেন্ট ক্রিয়েটর বা অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকেন। এমনকি শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রিজিমের বিরুদ্ধে তাদের দেওয়া ন্যারেটিভ এবং অনেক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাও ইতিবাচকভাবে কাজে লেগেছে। জুলাই বিপ্লব ও তৎপরবর্তী সময়ে ফ্যাসিস্টদের দেশবিরোধী কার্যক্রমের বিরুদ্ধেও এসব অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তেমনই জনপ্রিয় কিছু অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের নিয়ে এই আয়োজন।

পিনাকী ভট্টাচার্য: উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে জনপ্রিয় এই অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টের জন্ম ১৯৬৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর। বগুড়া জেলা স্কুলের শিক্ষক শ্যামল ভট্টাচার্যর ছেলে পিনাকী চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়লেও সেই পেশায় স্থায়ী হননি। তরুণ বয়সে বাম রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে থাকা পিনাকী ধীরে ধীরে লেখক হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ব্যক্তিজীবনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সহপাঠী আঞ্জুমান আরা বেগমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। রোসেফ আঞ্জুমান নামে তার একটি ছেলে সন্তান রয়েছে।

উইকিপিডিয়া বলছে, এ পর্যন্ত তিনি ১৯টি বই লিখেছেন, পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও নিয়মিত কলাম লিখে আসছিলেন। ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের পর তিনি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর টার্গেটে পরিণত হন। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর তার দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তবে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তিনি দেশত্যাগ করতে সক্ষম হন। প্রথমে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে গেলেও পরে ফ্রান্সে পাড়ি জমান পিনাকী ভট্টাচার্য। বর্তমানে সেখানেই তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন।

পিনাকী রাজনৈতিক বিষয়ে ফেসবুক ও ইউটিউবে নানা ধরনের কন্টেন্ট নিয়ে নিয়মিত সরব থাকেন। তার কন্টেন্টগুলো এতো জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, ফেসবুক-ইউটিউব মিলিয়ে তাকে অনুসরণ করা ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় অর্ধ কোটি দাঁড়িয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার, ভারতের আধিপত্যবাদ, দেশের রাজনীতিতে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভূমিকার বিশ্লেষণ নিয়ে তিনি হাজির হয়েছেন। শেখ হাসিনার একটি ভাষণকে কেন্দ্র করে তার ডাকে সাড়া দিয়ে গত ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয় ছাত্র-জনতা।

সবশেষ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ক্ষেত্রেও তিনি অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে জোরালো ভূমিকা রাখেন। গত ১৫ মার্চ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে (সিপিবি) ফ্যাসিবাদের সহযোগী আখ্যা দিয়ে পল্টনে অবস্থিত মুক্তি ভবন দখলের ডাক দেন পিনাকী। তবে সেই ডাকে তিনি খুব একটা সাড়া পাননি। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ও রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনেও সমর্থন দেন পিনাকী ভট্টাচার্য। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্যের কারণে সেসব দাবি অন্তর্বর্তী সরকার মেনে নেয়নি। সরকারের একাধিক উপদেষ্টা এবং রাজনৈতিক দল বিএনপির অনেক নেতা সম্পর্কেও নানান সময়ে বিভিন্ন মতামত দিয়ে আলোচিত-সমালোচিত তিনি। প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের সামনে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে জিয়াফত কর্মসূচিতেও ছিল তার ভূমিকা।

ইলিয়াস হোসেন: সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন ১৯৮৪ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। কর্মজীবনে ইলিয়াস চ্যানেল ওয়ানে
গুড মর্নিং বাংলাদেশ ও একুশে টেলিভিশনে অপরাধ ভিত্তিক অনুসন্ধানী অনুষ্ঠান একুশের চোখ-এর উপস্থাপনা করেন। একপর্যায়ে প্রভাবশালীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে চাকরি হারিয়ে ২০১৫ সালের দিকে দেশ ছাড়েন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় চান তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে থাকাকালে বাংলাদেশের রাজনীতিসহ অনলাইনে বিভিন্ন কন্টেন্ট তৈরি করেন ইলিয়াস। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান বনজ কুমারের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন তিনি। যেখানে ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত নিয়ে সংস্থাটির প্রধান বনজ কুমারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এরপর তার নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেন বনজ কুমার। মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়।

দেশ ছাড়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নানাভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ভূমিকা রাখেন ইলিয়াস হোসেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের সম্মুখ সারিতে ছিলেন তিনি। পিনাকী ভট্টাচার্যের সঙ্গে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটিকে ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি অভিহিত করে তা গুঁড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন ইলিয়াসও। এ ছাড়া সরকারের একজন উপদেষ্টাকে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র
-এর দালাল আখ্যা দিয়ে একাধিক ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি করেন তিনি। চলতি বছর জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মেজর ডালিমের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেন।

জুলকারনাইন সায়ের খান সামি: শেখ হাসিনা সরকারের ভিত কাঁপানো অন্যতম প্রতিবেদন ছিল আল জাজিরার আলোচিত
অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন প্রতিবেদন। সচিত্র প্রতিবেদনটি সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের নানা অপকর্ম নিয়ে তৈরি। যারা তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশীর্বাদ ও সহায়তায় গড়ে তোলেন দুর্নীতি ও অপরাধের স্বর্গরাজ্য। শেখ হাসিনার সঙ্গে গোপন চুক্তির মাধ্যমে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের বৈতরণী পাড়ি দিতে সহায়তা করেন আজিজ আহমেদ।

ওই প্রতিবেদন তৈরিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান সামি। এরপর থেকে বাংলাদেশে অনলাইনে তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মো. আব্দুল বাসেত খানের ছেলে জুলকারনাইন সায়ের খান, যিনি সামি হিসেবেই বেশি পরিচিত। জন্ম ১৯৮৪ সালে। সেনা কর্মকর্মকর্তার ছেলে হিসেবে সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই
তে সামির অনেক পরিচিত লোক ছিলেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তিনি বিডিআর বিদ্রোহ, গুমসহ বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করেন। ছাত্রজনতার আন্দোলনে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়েও তথ্য প্রকাশ করেন। সবশেষ ৩ আগস্ট সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ বৈঠকের সূত্র ধরে সামিই আশ্বস্ত করেন যে, সেনাবাহিনী জনতার ওপর গুলি চালাবে না। তার এসব বার্তা আন্দোলনে দুর্দান্ত প্রভাব ফেলেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অ্যাক্টিভিস্ট যখন সেনাপ্রধান নিয়ে বিষোদগার করেন, তখন তিনি সেনাপ্রধানের সমর্থনে বক্তব্য রাখেন। অ্যাক্টিভিজমে থাকলেও শেখ হাসিনার পতনের পর তিনি দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে সামনের দিকে আগানোর ওপর জোর দিয়ে আসছেন।

তাসনিম খলিল: পেশাগতভাবে সাংবাদিক ড. তাসনিম খলিল। সুইডেন প্রবাসী এই সাংবাদিক অনলাইনে অ্যাক্টিভিজমের মাধ্যমেও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তবে তার কন্টেন্টগুলো নিজের পরিচালিত সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজের মাধ্যমেই সামনে এসেছে বেশি। ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট আলোচিত
আয়নাঘরের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে নেত্র নিউজ। সচিত্র সেই প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচক, অ্যাক্টিভিস্ট ও ধর্মীয় কারণে সরকারের রোষানলে পড়া ব্যক্তিদের গুম করে আলোচিত সেই আয়নাঘরের বিষয়টি সামনে আসে। জুলকারনাইন সায়েরের সঙ্গে তৈরিকৃত প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, গুম থেকে ফিরে এসে অনেকে মুখে কুলুপ আটেন, কাউকে পাওয়া যায় ভারতে, কারও লাশ মিললেও অনেকেরই জীবিত বা মৃত কোনোভাবেই মেলেনি অনুসন্ধান। নেত্র নিউজের সেই প্রতিবেদন থেকেই আয়নাঘর শব্দটি বহুল আলোচিত হয়। শেখ হাসিনার পতনের পর যুদ্ধাপরাধ মামলায় দণ্ডিত দুজন জামায়াত নেতার সন্তান আব্দুল্লাহিল আমান আযমী ও মীর আহমদ বিন কাসেম এবং ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমা আয়নাঘর থেকে মুক্তি পান।

তাসনিম খলিলের জন্ম ১৯৮১ সালে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সিএনএন-এর সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। এ ছাড়া মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পরামর্শক ছিলেন। এক-এগারো সরকারের সময় গ্রেপ্তার ও নির্যানের শিকার হন তিনি। পরবর্তীতে দেশ ছেড়ে সুইডেনে আশ্রয় নেন। প্রবাসে থাকাকালে বাংলাদেশে মানবাধিকার, রাজনৈতিক নিপীড়নসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি সোচ্চার ছিলেন। সম্প্রতি জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে তাসনিম খলিল জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

উল্লেখযোগ্য এসব অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা ছাড়াও অনেকে দীর্ঘদিন ধরে ব্যক্তিগত প্ল্যাটফর্ম থেকে জনমত তৈরিতে ভূমিকা পালন করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে সাংবাদিক
খালেদ মহিউদ্দিন, সাংবাদিক ড. কনক সারওয়ার, সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহ, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর নুরুজ্জামান কাফি প্রমুখ। তাদের অনেকে দীর্ঘদিন ধরে আবার অনেকে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় থেকে অনলাইনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

জুলাই পূর্ববর্তী সময়ে এসব অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা সবাই ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সমালোচকের ভূমিকা পালন করেন। তবে ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের মধ্যে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেক ইস্যুতে তাদের পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিতেও দেখা যাচ্ছে।

মতপার্থক্য ও বিতর্ক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে নিয়ে বেশ সমালোচনা মুখর ছিলেন পিনাকী ভট্টাচার্য ও ইলিয়াস হোসেন। এর প্রেক্ষিতে চলতি বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাওয়া ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান বলেন,
একটা কমন জিনিস আমি দেখতে পাচ্ছি, সেনাবাহিনী এবং সেনাপ্রধানের প্রতি বিদ্বেষ কারো কারো। কিন্তু কী কারণে, আজ পর্যন্ত আমি এটা খুঁজে পাইনি। আমরা হচ্ছি একমাত্র ফোর্স, যেটা আপনাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছি, দাঁড়িয়ে আছি প্ল্যাটফর্মে। অবকোর্স নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স। নেভি, এয়ারফোর্স উই অল। আমাদের সাহায্য করেন, আমাদের আক্রমণ করবেন না। আমাদের অনুপ্রাণিত করেন, আমাদের উপদেশ দেন। আমাদের প্রতি আক্রমণ করবেন না। উপদেশ দেন, আমরা অবশ্যই ভালো উপদেশ গ্রহণ করব। আমরা একসঙ্গে থাকতে চাই এবং দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।

সেনাপ্রধানের সেই দিনের বক্তব্য নিয়েও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া একাংশ সমালোচনা করেন। পরবর্তীতে আরেক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট জুলকারনাইন সায়ের সেনাপ্রধানের পক্ষ নিয়ে ফেসবুকে লেখেন, দেশের সেনাপ্রধান তো আর বিড়াল না যে মিঁউ মিঁউ কইরা কথা বলবেন। তিনি সৈনিক, সৈনিকের মতোই কথা বলবেন। প্রেম-পিরীতের মিষ্টি আলাপ, আর বাইসেপ দেখায়ে চেঁচামেচি করা তাঁর কাজ না।

উপদেষ্টা ও রাজনীতিবিদদের নিয়ে বিতর্ক: সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন সম্প্রতি আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেন। সেখানে তার ভূমিকা নিয়ে নানা বক্তব্য তুলে ধরেন। পরবর্তীতে অধ্যাপক আসিফ নজরুল এ বিষয়ে বলেন, একটা ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে, ৩-৪ আগস্ট রাতে আমি নাকি আর্মি অফিসারদের নিয়ে এবং ভারতের দালালদের নিয়ে মিটিং করেছি। আমি অবাক হয়ে যাই, মানুষের কল্পনারও একটা সীমা থাকা উচিত। মিথ্যা কথা কেন বলব।

অধ্যাপক আসিফ নজরুলের পক্ষ নিয়ে আরেক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ফেসবুক পোস্টে লেখেন, সমালোচনারও কিছু ম্যানার থাকা দরকার যেটাকে গঠনমূলক সমালোচনা বলা হয় আরকি। এসব বিষয়ে কিছু বলতে চাইনি, কিন্তু এর এজেন্ট বলার পর আর চুপ থাকা গেল না। অবশ্য আপনাদের কন্সপিরেসি থিওরিতে আমাদের আন্দোলনও পরিচালিত ছিল। যে আন্দোলনে পরবর্তীতে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন হলো। আমরা এবার একটু কনস্ট্রাকটিভ হই, না হলে এত ত্যাগের ফলে যে দেশ গড়ার স্বপ্ন আমরা দেখছি, তা ভূলুণ্ঠিত হবে। এতটুকুই আহ্বান থাকবে ।

অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের অনেকে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সমালোচনায়ও মুখর ছিলেন। তেমনই এক সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছিলেন, বিদেশে অবস্থানরত তথাকথিত সাংবাদিক, সালমান এফ রহমানের টাকা খেয়ে যার স্বাস্থ্য চেহারা মোটা হয়েছে, এমন লোকটা প্রায়ই আমার বিরুদ্ধে যেগুলো ফেসবুকে আসে প্রায়ই বলেন, কেন মানবেন না? আপনাদের কি স্টেক আছে? কেন মির্জা আব্বাস সাহেবরা মানবেন না? আরে ভাই তোমার যেমন বিদেশে পালাইয়া থাইকা কথা বলার অধিকার আছে, আমার কি দেশে থেকে কথা বলার অধিকার নাই? আমি এই দেশে থেকে মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে, জেল-জুলুম মাথায় নিয়ে, জেলে থেকে আমার সহকর্মীদের নিয়ে আমি এই দেশেই আছি, পালিয়ে যাইনি। আপনারা তো পালাইয়া গিয়া লম্বা লম্বা কথা বলতেছেন। আপনারা তো জীবনে কোনদিন দেশে আসবেন না।

তিনি আরও বলেন, আপনাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলতে চাই, ভাই আমরা রাজনীতি ছেড়ে দেব। আপনারা দেশে আসেন। আপনাদের অনেক জ্ঞান, আপনাদের অনেক বুদ্ধি। আপনাদের জ্ঞান-বুদ্ধি আমাদের অনেক প্রয়োজন। আপনারা দয়া কইরা দেশে আসেন, বুদ্ধি দেন, কথা বলেন, কাজ করেন। দেশে আসবেন না, আবার টিটকারি মেরে কথা বলবেন, সমালোচনা করবেন, জাত-গোষ্ঠী উদ্ধার করবেন, এগুলো কেমন কথা। ওরা তো টাকা কামানোর জন্য এগুলো বলে।

কিছু বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনা সত্ত্বেও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তারা জনমতকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন। তারা গণমাধ্যমের বিকল্প গণমাধ্যম, রাজনীতির বিকল্প রাজনীতি, ন্যারেটিভের বিকল্প ন্যারেটিভ তৈরি করার ক্ষমতা রাখেন। সেই ক্ষমতাকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে পারলে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে জুলাই বিপ্লবের ন্যায়ও ভবিষ্যতেও তারা হয়ে উঠতে পারেন সহায়ক শক্তি।

কেআই/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।