শেখ হাসিনা এখন দিল্লিতে আশ্রিত—এ দৃশ্য বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে নিছক সফর নয়, এক বেদনাদায়ক সত্য। এটা এখন আয়নার মতো স্বচ্ছ, পরিষ্কার যে তাঁর ক্ষমতার শিকড় বাংলাদেশের মাটির গভীরে নয়, বরং ভারতের করুণার ওপর ঝুলে আছে।
অথচ তিনি এখন সীমানা পেরিয়ে ভারতের রাজধানীতে বসে আছেন পরম আত্মীয়ের মতো। জনগণের চোখে এটি কোনো কূটনীতি নয়, এক নির্মম নাটক, যেখানে বার্তাটি পরিষ্কার : তিনি ঢাকা নয়, দিল্লির ছায়ায় শক্তি খোঁজেন। বিগত দিনগুলোতে একই কাজ করেছেন তিনি।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকতে দিল্লিকে দিয়েছেন অঢেল, বিনিময়ে কিছুই প্রত্যাশা করেননি।
এ কথা তাঁর মুখে হরহামেশা শুনেছি আমরা। শুধু শুনেছি বললে ভুল হবে, বাস্তবে দেখেছিও বটে। ট্রানজিট দিয়েছেন ভারতকে, বিনিময়ে কিছুই নেননি। বন্দর ছেড়ে দিয়েছেন তাদের।
সর্বশেষ বাংলাদেশের বুক চিরে দিয়েছিলেন রেললাইন। ভারতের আপত্তির মুখে তিস্তা প্রকল্প চীনকে দেননি লাভজনক হওয়া সত্ত্বেও। সবই করেছেন তিনি ভারতকে খুশি রাখার জন্য। এখন তো বোঝাই যাচ্ছে কেন তিনি এই কাজগুলো করেছিলেন? পিতৃ প্রদত্ত জীবনের চেয়ে পৃথিবীতে আর কিই বা বড় থাকতে পারে? সেই জীবনটাই তো রক্ষা করল ভারত। এর চেয়ে বিনিময়ে আর কী চান শেখ হাসিনা? দলের শীর্ষ নেতাদের আশ্রয় দিয়েছে ভারত।
রাজনীতি করারও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এখন শেখ হাসিনার সেই আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দিল্লি। এখন বলা যায়, শেখ হাসিনা দিল্লিকে যা দিয়েছেন, সেটা দিল্লি আজীবন মনে রাখবে। এটা কোনো গোপন বিষয় নয়, একেবারে ওপেন সিক্রেট।
শেখ হাসিনা সে জন্য ভারতের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখেই বিগত ১৬ বছর বাংলাদেশের জনগণের ওপর দিব্বি ছড়ি ঘুরিয়েছেন, নানা ধরনের নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। ২০১১ সালে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধানসংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর নাটকের প্রথম অঙ্ক। জনগণের ভোট ছাড়াই ২০১৪ সালে গঠন করা হয় সরকার। তীব্র প্রতিরোধের মুখে সেদিন নাটকের দ্বিতীয় অঙ্ক মঞ্চস্থ করে বলেছিলেন, এটা সংবিধান রক্ষার নির্বাচন, অচিরেই মধ্যবর্তী নির্বাচন দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি কথা রাখেননি। বিনা ভোটে নির্বাচিত সরকারকে টেনে নিয়ে যান পাঁচ বছর।
২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল সেই নাটকের তৃতীয় অঙ্ক। এ সময়ের মধ্যে বিএনপির হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হলো, খালেদা জিয়াকে ঠেলে দেওয়া হলো অন্ধকার কারাগারে। জনগণের ভোটাধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হলো। যা কিনা ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে ‘দিনের ভোট রাতে’ করার গল্প হিসেবে। অথচ সেই হাস্যকর নির্বাচনে বিজয়ী হাসিনাকে ভারত এক নিমিষে অভিনন্দন জানিয়ে দিল। মানুষের মনে তখন একটাই প্রশ্ন জাগল—যে দেশ স্বাধীনতাযুদ্ধে রক্ত-ঘামে পাশে ছিল, আজ কি সেই দেশই বাংলাদেশের গণতন্ত্র হত্যার পৃষ্ঠপোষক?
শেখ হাসিনার সরকার ভারতের সঙ্গে যে বাণিজ্য, নিরাপত্তা ও নদীপথের চুক্তি করেছিল, সেগুলো জনগণের চোখে উন্নতি নয়, আত্মসমর্পণের দলিল। আর যখন ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে কণ্ঠরোধ শুরু হলো, তখন ভারতীয় নীরবতা আরো শীতল ও ভীতিকর হয়ে উঠল। সাংবাদিক, ছাত্র, লেখক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট—যে কেউ প্রতিবাদ করলে তার ঠিকানা কারাগার। জাতিসংঘ চিৎকার করে বলল, এটি নিছক মতপ্রকাশ দমনের হাতিয়ার। অথচ দিল্লি নিশ্চুপ! সেই নীরবতা যেন ঢাকায় চলমান নিপীড়নের সহায়ক হয়ে দাঁড়াল।
সবচেয়ে করুণ চিত্র ছিল দিল্লিতে হাসিনার অভ্যর্থনা। তাঁকে স্বাগত জানালেন অজিত ডোভাল, ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা, যিনি গোটা অঞ্চলের গোপন খেলার পরিচিত নাম। বাংলাদেশের মানুষের চোখে এটি ছিল আরেকটি আঘাত। হাসিনা যেন আর বাংলাদেশের নেত্রী নন, বরং ভারতের গোয়েন্দা যন্ত্রের প্রতিনিধি।
আজ রাস্তায় মানুষের কণ্ঠ গর্জে উঠছে। তারা আর কোনো অজুহাত মানছে না। তারা শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরাতে চায়—বন্দি রাজনীতিবিদদের জন্য, ভুয়া নির্বাচনের জন্য, রক্তাক্ত রাস্তাঘাটের জন্য, সংবাদপত্রের কালো অধ্যায়ের বিচারের জন্য। তারা চায় তিনি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ান, বিদেশি পতাকার ছায়ায় নয়, বাংলাদেশের মাটিতেই জবাব দিন।
দিল্লিতে শেখ হাসিনার এই আশ্রয়দানকে কেন্দ্র করে ফুঁসে উঠেছেন ভারতের অনেক রাজনৈতিক দলের নেতা। তাঁদের একজন ভারতের অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম) প্রধান ও হায়দরাবাদের সংসদ সদস্য আসাদউদ্দিন ওয়াইসি । তিনি বলেছেন, সরকার যদি সত্যিই ‘অবৈধ বাংলাদেশিদের’ ভারত থেকে ফেরত পাঠাতে চায়, তবে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠিয়ে সেটি শুরু করা উচিত।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর ‘আইডিয়া এক্সচেঞ্জ’ অনুষ্ঠানে ওয়াইসি বলেন, ‘ওই ক্ষমতাচ্যুত নেত্রীকে (হাসিনা) আমরা দেশে কেন রেখেছি? তাঁকে ফেরত পাঠানো হোক। উনি কি বাংলাদেশি নন?’
তাহলে শেখ হাসিনাকে দিয়েই পুশইন শুরু করা হোক বাংলাদেশে। বাংলায় কথা বলা শুনলেই যদি গা জ্বলে যায় মোদি সরকারের, শেখ হাসিনা কি হিন্দিতে কথা বলেন? বাংলায় কথা বললে তাকে বাংলাদেশি ট্যাগ লাগিয়ে পুশইন করা হচ্ছে—হোক সে পশ্চিমবঙ্গের ত্রিপুরার কিংবা আসামের, কোনো খাতির নেই—বাংলায় কথা বললেই তাকে পুশ ইন করে। অথচ মানবতাবিরোধী অপরাধ করেও দিব্যি আরাম-আয়েশে আছেন শেখ হাসিনা। তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করতে বাংলাদেশে পাঠানো হোক—এটাই জনগণের দাবি। জনগণের ক্ষোভ আসলে এক দাহ্য আগুন। এটি শুধু রাজনীতির প্রশ্ন নয়, আত্মমর্যাদার লড়াই। তারা বলে দিচ্ছে : ‘আমরা চাই না সীমান্ত পেরোনো কোনো পলায়নপর নেত্রী। আমরা চাই জবাবদিহি, চাই ন্যায়বিচার, চাই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। আর এ লড়াই থামবে না যতক্ষণ না সেই দিন আসে, যেদিন নেতা নয়, জনগণ হবে প্রকৃত ক্ষমতার মালিক। ’
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক