বাংলাদেশে পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্যের প্রধান হোতা শাজাহান খান। শাজাহান খান সেই ব্যক্তি যিনি বলেছিলেন, ‘গরু-ছাগল চিনলেই একজন গাড়িচালক লাইসেন্স পেতে পারেন।
শাজাহান খান নিজে পরিবহন শ্রমিক না হলেও তিনি পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের নেতা সেজে সারা দেশের পরিবহন সেক্টরে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি করার জন্য গড়ে তুলেছিলেন তার নিজস্ব পরিবহন সিন্ডিকেট। গত ১৫ বছরে পরিবহন খাতের চাঁদাবাজির আয়ের উৎস দিয়ে ধনসম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ১৫ বছরে পরিবহন সেক্টরের ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান ও তার পরিবহন সিন্ডিকেট। শাজাহান খানের অবৈধভাবে অর্জিত হাজার হাজার কোটি টাকার আয়ের উৎসের সন্ধানে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এক যুগ আগেও তার ঢাকা শহরে ছিল না কোনো ফ্ল্যাট বা জমি। মন্ত্রিত্ব পাওয়ার আগে তার মাসিক আয় ছিল ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। মন্ত্রী হওয়ার পর তার সম্পদ বেড়েছে প্রায় শতগুণ। নিজ জেলা মাদারীপুর আর ঢাকা শহরে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। আছে আবাসন, হোটেল ও শিপিং ব্যবসা। গত ৯ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) চিঠি দিয়ে সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন ঢাকা সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতি। সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানসহ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের তিন নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে গত চার বছরে প্রায় ৬ হাজার ৯৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে করেছে সংগঠনটি।
এ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হানিফ খোকন অভিযোগ করেছেন, সড়ক পরিবহন আইনের তোয়াক্কা না করে তারা চাঁদাবাজির মাধ্যমে এ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে বারবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও এতদিন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শাজাহান খান ছাড়া বাকি অভিযুক্তরা হলেন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোখলেছুর রহমান। চিঠিতে দুদককে অভিযোগ তদন্ত করে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানানো হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের আমলে নেওয়া অভিযোগে জানা গেছে, সড়কে চাঁদাবাজিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান। ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ২৪৯ শ্রমিক ইউনিয়নের মাধ্যমে চাঁদা তোলা হয়েছে। এর একটি বড় অংশ নিয়মিত গেছে শাজাহান খানের পকেটে। ফেডারেশনের শীর্ষ নেতা হওয়ার সুবাদে পরিবহন মালিক সমিতির অপর প্রভাবশালী নেতাকে সঙ্গে নিয়ে সড়ক থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন। তার ছিল নিজস্ব মাস্তান বাহিনী। এ বাহিনীর কাছে বছরের পর বছর জিম্মি পরিবহন মালিকরা। বিগত সময়ে বিএনপির নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিসহ অন্যান্য দাবিতে বৃহৎ পরিসরে আন্দোলনের ডাক দিলেই বন্ধ হয়ে গেছে সড়কের যান চলাচল। এর নেপথ্যেও ছিলেন এই শাজাহান খান। সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের অন্যতম বাধাও ছিলেন তিনি। সারা দেশের পরিবহন সেক্টরের শৃঙ্খলা ফেরাতে উদ্যোগের অন্যতম বাধা ছিলেন শাজাহান খান।
একাধিক পরিবহন শ্রমিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সড়ক পরিবহন আইনে রাস্তা থেকে চাঁদা ওঠানোর কোনো বিধান নেই। এরপরও পরিবহন খাতে বেপরোয়া চাঁদাবাজির নেতৃত্বে ছিলেন শাজাহান খান। বিভিন্ন টার্মিনাল, উপজেলা পর্যায়ে চাঁদা তুলে পাঁচ ভাগের এক ভাগ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নামে গেছে। এই ফেডারেশনের সবকিছুই চলেছে শাজাহান খানের ইশারায়।
শাজাহান খান ও সহযোগীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে পরিবহনে চাঁদাবাজির স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। চাঁদাবাজির আয়ে পরিবার, পরিজন, আত্মীয়স্বজনের নামে তারা বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ও সম্পদ করেছেন। পরিবহন শ্রমিক নেতারা বলেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে আমাদের আবেদন, অনতিবিলম্বে তদন্ত করে এসব অবৈধ সম্পত্তি জব্দ করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হোক। মালিকরা অভিযোগ করেছেন, পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। সরকারের বাসভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব ছিল শাজাহান খানের সিন্ডিকেটের। উপরন্তু সরকার নির্ধারিত ভাড়া না মানলেও পরিবহন কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারত না সরকার। আবার পণ্য পরিবহনে বাড়তি ভাড়া আদায়েও শাজাহান খানদের ইন্ধন ছিল।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার সড়ক আইন প্রণয়ন করলেও শাজাহান খানদের চাপে আইনের ধারা শিথিল করে। শাজাহান খানের ইশারাতেই কথায় কথায় যান চলাচল বন্ধ রেখে মানুষের ভোগান্তিকে জিম্মি করে দাবি আদায় করত পরিবহন কর্মীরা। এক কথায় শাজাহান খান ছিলেন পরিবহন খাতের মাফিয়া ডন।
পরিবহন মালিকদের অভিযোগ আমলে নেওয়া তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারে থেকেও পরিবহন খাতের জন্য বিকল্প সরকারের ভূমিকায় ছিল শাজাহান খানের অনুসারীরা। পরিবহন খাতে অন্যায়ভাবে চাঁদাবাজিকে বৈধতা দিয়েছিলেন শাজাহান খান-ওসমান আলী গ্রুপ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের বিভিন্ন শ্রমিক গ্রুপের সবাই চলেছে শাজাহান খানের ইশারায়।
সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ও মালিক সমিতির নির্দেশিকার ৪১টি ধারায় সড়কে চাঁদাবাজিকে দেওয়া হয় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। নির্দেশিকায় ঢাকা মহানগর এলাকা ও শহরতলির মধ্যে কোথায়, কোন রুটে, কে চাঁদা তুলবে, আন্তজেলায় চলা যানবাহনে ঢাকার কোন স্পটে কারা চাঁদা তুলবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর চাঁদা তোলার বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে নির্দেশিকায়।
নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রতিদিন একটি বাণিজ্যিক যানবাহন থেকে একবার ৫০ টাকা হারে চাঁদা তোলার কথা। কিন্তু বাস্তবে এক দিনে ১৫ থেকে ২০ বারও চাঁদা দিতে হচ্ছে এসব যানবাহনকে। শাজাহান খানের অনুসারীদের কাছে বছরের পর বছর জিম্মি ছিলেন পরিবহন মালিকরা। শাজাহান খান ও তার সহযোগীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে পরিবহনে চাঁদাবাজির স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছিলেন।
সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন