ঢাকা, সোমবার, ১০ ভাদ্র ১৪৩২, ২৫ আগস্ট ২০২৫, ০১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

অন্যান্য

বিশেষ লেখা

রমরমা মাদক কারবার তারুণ্যের মহাসর্বনাশ

মোস্তফা কামাল। সৌজনৌ: কালের কণ্ঠ |
আপডেট: ০৮:৪৩, আগস্ট ২৫, ২০২৫
রমরমা মাদক কারবার তারুণ্যের মহাসর্বনাশ মোস্তফা কামাল

শিল্প-কারখানার কাঁচামাল ও সরঞ্জাম আমদানি কমে গেছে। কেবল স্থবিরতা নয়, বিনিয়োগ নেমেছে তলানিতে।

বাজারে নিত্যপণ্যের সংকট-ঘাটতি দেখা দিচ্ছে প্রায়ই। মানুষের কেনাকাটা কমে গেছে।

তাই এক দিনের সদাই দিয়ে তিন দিন চলার চেষ্টা। কিন্তু মাদকের হাট-বাজার বেশ চাঙ্গা। সেখানে আমদানিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কেনাকাটা, স্টক সবই উপচে পড়ছে।

সাপ্লাই চেইন এবং নিরাপত্তা রয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চাহিদা মতো!
মাঝেমধ্যে টুকটাক গোলমাল বাধছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের নিজস্ব গণ্ডগোলে বা খবরদারি নিয়ে অথবা নেশাগ্রস্ত হয়ে ছেলে বাবা-মার ওপর বা বাবা ছেলের ওপর চড়াও হলে। দুই দিন আগে কিশোরগঞ্জে মাদকের কারবারের আধিপত্য নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত ও অনেকে আহত না হলে জানাই হতো না সেখানে বিনা বাধায় মাদকের কী কারবার চলে আসছিল। এ ঘটনায় জেলা-উপজেলা যুবদল নেতা আলী আব্বাস রাজন ও এমদাদুল হককে বহিষ্কার না করলে কজন জানত জায়গায় জায়গায় এ ব্যবসার হাতবদল কিভাবে হয়েছে? প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মাদক কারবারিদের কাছে ভাব এবং মূর্তি কোনো বিষয় নয়।

মাদকসহ হেন বাজে কাজ নেই, যা করলে তাদের ভাব বা মূর্তিতে কোনো সমস্যা হয়। কম-বেশি সারা দেশের চিত্র এমনই। আগের কারবারিরা গাঢাকা দিয়েছে, নতুন কারবারি গজিয়েছে। বর্তমান-সাবেকে বোঝাপড়ায়ও মাদকের কারবার চলছে বিভিন্ন জায়গায়। মাদকের এই গরম বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতা উপচে পড়ছে।

ব্যাপক অর্থলগ্নিও সেখানে। আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে মার্কেটিংয়ে কোনো সমস্যা নেই। কারবারি ও খোরদের সৃষ্ট অঘটনে মাঝেমধ্যে গোলমাল পাকে। পুলিশ-নারকোটিকস বিভাগের লোকেরা তখন একটু ঝামেলায় পড়ে যায়। কয়েকটা দিন তৎপরতা চালিয়ে কিছু মাদক উদ্ধার ও গায়েক বা কাস্টমার ধরে কাজ দেখাতে হয়। পরে দ্রুত তা সামলে যায়। পাওনা হিসাবে এ সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ মনমতো পদ-পদায়ন-পদোন্নতি মেলে। মাদক রাজ্য চলে আসছে এভাবেই। রাজনৈতিক অঙ্গনে এত বড় পরিবর্তনের পর সেখানে কোনো হেরফের আসেনি। বরং মাদক কারবার আরো বেড়েছে। ডালপালা ছড়িয়েছে।

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ‘মাদকাসক্ত’ ছেলে তপন রুদ্র তার বাবা দুলাল রুদ্রকে কুপিয়ে মেরে না ফেললে আলোচনায়ও আসত না সেখানকার মাদক কারবারিদের কথা। বরিশালের খাটিয়ালপাড়ার নেশাগ্রস্ত ছেলে শাহারিয়ার শিমুলও তার বাবা শাহ আলম খানের দেহ থেকে মাথা আলাদা করে দেওয়ায় সেখানে কয়েকটা দিন একটু গরম অবস্থা গেছে। ধরপাকড়সহ কিছু কাজ দেখাতে হয়েছে পুলিশ, মাদককর্তাসহ প্রশাসনকে। ঢাকাঘেঁষা নারায়ণগঞ্জ সদরে বাবা করুণা রায় ও মা অনিতা রানী ঘটিয়েছেন উল্টো কাণ্ড। তাঁরা মাদকাসক্ত ছেলে জনির কাছে গর্দান সোপর্দ করেননি। অতিষ্ট হতে হতে মাদকাসক্ত ছেলেকেই মেরে লাশটা নালায় ফেলে দিয়েছেন।

মাঝেমধ্যে এ ধরনের কিছু ঘটনা বাদে মাদক ব্যবসার বিস্তার আরো বাড়ছে। আমদানি ব্যাপক। কাস্টমার প্রচুর। সমানতালে মাদকসংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমাও। কেবল রাজধানী ঢাকা বা বড় বড় শহর নয়, প্রত্যন্ত গ্রামেও এখন হাত বাড়ালেই মিলছে নানা জাত ও নামের নেশাদ্রব্য। ঢাকার অভিজাত গুলশান-বনানী-উত্তরা থেকে কারওয়ান বাজার, মগবাজার,  কামরাঙ্গীর চর, মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, মুগদা, মিরপুর, পল্লবী, রাজারবাগ পুলিশ লাইন লাগোয়া মোমেনবাগ, শান্তিবাগ, ঝিগাতলার অলিগলিতে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রকাশ্যে চলে মাদক সেবন, বিক্রি। পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লোকেরা মাঝেমধ্যে একটু হম্বিতম্বি করে পাওনা বুঝে নিয়ে আসে।  কয়েকটি স্পটে কাস্টমারের ভিড় সামলানো কঠিন। দীর্ঘ লাইন ধরে ‘মাল’ কিনতে হয়। দেশের মানুষ যখন নির্বাচন, সংস্কার, বিচার, ঐকমত্য ধরনের ভারি বিষয়াদি নিয়ে ব্যস্ত, তখন মাদকের কারবারে জড়িয়ে জনমের কামাই-রোজগারে মত্ত একটি মহল। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী, প্রভাবশালী ব্যক্তি, পরিবার, পুলিশ, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ কয়েকটি গোষ্ঠীর মাদকের দিকে বিশেষ প্রাপ্তির চোখ। গেল টানা ১৫-১৬ বছর এই কারবারে জড়িতরা আলামত বুঝে কেউ গাঢাকা দিয়েছে, পালিয়েছে, কেউ কেউ সাময়িক হাত বদল করে কিছু পাওনা বুঝে নিচ্ছে।

বাজার বুঝে মাদকের আমদানিকারকদের এখন মহাব্যস্ত সময়! মদ, গাঁজা, ইয়াবার বাইরে আরো নানা ধরনের মাদককে সহজলভ্য করে তুলছেন তাঁরা। সাপ্লাই চেইনে এনেছেন নতুনত্ব। নিষিদ্ধ জগতে অস্ত্রের পর মাদকই সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, মদ,  আফিম, হেরোইন, কোকেন, প্যাথেডিন, বিভিন্ন ধরনের ঘুমের ওষুধ, এমনকি জুতার আঠাও রয়েছে। এসব ভয়ানক নেশাজাতীয় দ্রব্য সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন! এসব মাদকের বেশির ভাগই আসে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মায়ানমার থেকে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে। মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ মাদকের বড় ঝুঁকিতে। এশিয়ার গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল, গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গোল্ডেন ওয়েজ নামে পরিচিত মাদক চোরাচালানের তিনটি প্রধান অঞ্চলের কেন্দ্রে বাংলাদেশের অবস্থান। তাই আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিরাও বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে সহজে ব্যবহার করতে পারছেন। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে শত শত নদ-নদী দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মিলেছে। তাই মাদক চোরাকারবারিদের কাছে সমুদ্র উপকূল ও জলপথ উপযুক্ত পথ। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে  মাদকের রুট।

ক্লায়েন্ট হিসেবে তাদের টার্গেট পয়েন্টে সম্ভাবনাময় বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী। মাদকের এই নীল দংশন থেকে তরুণ ও যুবসমাজকে বাঁচাতে সরকারের পদক্ষেপের চেয়ে কারবারিদের চাতুরি ও নেটওয়ার্ক বেশি শক্তিশালী। তাদের কৌশলেও প্রতিনিয়ত অভিনবত্ব। তাদের বিশেষায়িত রুট এখন মায়ানমার। যেখানে মায়ানমারে কেবলই নৈরাজ্য আর অস্থিরতার খবর, সেখানে সঙ্গোপনে এবং নিঃশব্দে মাদক কারবারিদের কয়েকটি চক্রের এন্তার কারবার মায়ানমারের সঙ্গে। সেখান থেকে আনছে ইয়াবাসহ কয়েকটি আইটেমের বড় বড় চালান। এই মাদক পাচারের পেছনে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকারী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি এবং ট্রান্স ন্যাশনাল সিন্ডিকেটের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে।

আরাকান আর্মির রাখাইনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিত্যপণ্যের জন্য বাংলাদেশের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এই সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে মাদক কারবারিরা। বাংলাদেশ থেকে তারা নিচ্ছে চিনি, সার, পেঁয়াজ, সিমেন্ট, রসুন, লবণ, জ্বালানি, ভোজ্য তেল, শুঁটকি, চিংড়ি পোনা, চকোলেট, টিন, কাঠ, টাইলস, শাড়ি, থ্রিপিস, কম্বল, কসমেটিকস, গয়না, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন পণ্য। গত প্রায় পৌনে এক বছর ধরে দেশ থেকে ওষুধ, খাদ্য, নির্মাণসামগ্রী, কৃষি উপকরণসহ বিভিন্ন পণ্যের বিনিময়ে মায়ানমার থেকে ইয়াবা, আইসসহ আরো মাদকদ্রব্য আনছে তারা। পরিবহনে মাছ ধরার নৌযান তাদের মূল মাধ্যম। মায়ানমার থেকে সাগরপথে নৌযানে ইয়াবার চালান এনে নাফ নদ পার করে তা টেকনাফ, নাইক্ষ্যংছড়ি ও থানচি উপজেলার বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় জড়ো করার পর সেখান থেকে ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা দেশে। জায়গায় জায়গায় পুরনো কারবারিদের সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন কারবারি। দেশে নির্বাচনী তোড়জোর ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বাড়তি ব্যতিব্যস্ততা তাদের জন্য মৌসুমি সুযোগ!

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।