দিন দিন তীব্র হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট। আট বছর আগে প্রাণ বাঁচাতে মায়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা।
রাখাইন পরিস্থিতির কারণে তারা এখনো ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছে না। জোর করে তাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আপত্তি আছে। সংকট যখন বাড়ছে, তখন আবার কমছে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।
ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলার জন্য ৯৩ কোটি ৪৫ লাখ মার্কিন ডলার তহবিল চাওয়া হয়েছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে।
এর বিপীরতে গত ১১ আগস্ট পর্যন্ত ৩৩ কোটি দুই লাখ মার্কিন ডলার সহায়তা মিলেছে। এটি প্রত্যাশিত তহবিলের মাত্র ৩৫%।
২০১৮ সালে প্রত্যাশিত তহবিলের বিপরীতে ৭২%, ২০১৯ সালে ৭৫%, ২০২০ সালে ৬০%, ২০২১ সালে ৭৩%, ২০২২ সালে ৭০%, ২০২৩ সালে ৭১% এবং ২০২৪ সালে ৬৮% সহায়তা দিয়েছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান সংকট, বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা-ইসরায়েল সংঘাত এবং আফ্রিকার রাজনৈতিক অস্থিরতায় আন্তর্জাতিক সহায়তা কমার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
রোহিঙ্গা সংকট অনেক পুরনো ইস্যু হওয়ায় দাতা দেশগুলোর কাছে তা মনোযোগ হারাতে বসেছে। এ ছাড়া পশ্চিমা অনেক দেশ তাদের বৈশ্বিক সহায়তার তহবিল কাটছাঁট করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, একদিকে তহবিল কমে যাওয়ায় বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জীবনমান আরো অবনতির দিকে যাচ্ছে, অন্যদিকে তাদের প্রত্যাবাসনের পথও কার্যত বন্ধ। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে এই সংকটের বোঝা বহন করে আসছে, কিন্তু সমাধান অনিশ্চিত। দাতা দেশগুলো তহবিল কাটছাঁট করার সরাসরি বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও জীবনযাপনের সুযোগের ক্ষেত্রে।
মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জেনোসাইডের শিকার হওয়ার ইতিহাস বেশ পুরনো। কয়েক দশক ধরে চলমান জেনোসাইডের মধ্যেই ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মায়ানমারের সামরিক বাহিনী রাখাইনে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও জাতিগত নির্মূল অভিযান শুরু করে। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ গঠিত স্বাধীন তদন্ত মিশন সে সময় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন বলে জানায়। ওই অভিযানের সময় ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মায়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বড় অংশই বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ গঠিত ওই তদন্ত মিশনের সদস্যরা পরে নিজ উদ্যোগে ‘মায়ানমারের জন্য বিশেষ উপদেষ্টা পরিষদ’ গঠন করেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গড়া স্বাধীন ওই বিশেষ উপদেষ্টা পরিষদ মায়ানমারে শান্তি, প্রকৃত গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহির জন্য মায়ানমারের জনগণের লড়াইকে সমর্থন করার জন্য কাজ করছে।
মায়ানমারের জন্য বিশেষ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মারজুকি দারুসমান গতকাল রবিবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘একসময় রোহিঙ্গারা যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিল, এখন পুরো মায়ানমারকেই সেই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। মায়ানমারের রোহিঙ্গা রোহিঙ্গা জেনোসাইডের নকশাকার ও অপরাধী মায়ানমারের সামরিক বাহিনী সম্পূর্ণ দায়মুক্তি নিয়ে চলছে। ’
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের পর থেকে মায়ানমারের সামরিক জান্তা দেশব্যাপী নৃশংস অভিযান চালিয়েছে। তাদের ভয়াবহ হামলায় ৩৩ লাখেরও বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং তাদের সাহায্য অবরোধ রাখাইন রাজ্যের সম্প্রদায়গুলোকে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে।
‘মায়ানমারের জন্য বিশেষ উপদেষ্টা পরিষদের’ তথ্য অনুযায়ী, জান্তা এবং আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার ফলে রাখাইনের রোহিঙ্গা সম্প্রদায় মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। গত বছরের মে মাসে বুথিডং শহরে প্রায় ৬০০ রোহিঙ্গা পুরুষ, মহিলা এবং শিশুকে গণহত্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে এই গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে আরাকান আর্মি তা অস্বীকার করেছে।
মায়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক জাতিসংঘের সাবেক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি বলেছেন, ‘এই কথিত নৃশংস ঘটনা তদন্তের জন্য রাখাইন রাজ্যে আন্তর্জাতিক স্বাধীন তদন্ত দলগুলোর প্রবেশকে সহজতর করা এবং তাদের সম্পূর্ণ সহযোগিতা করার জন্য আমরা রাখাইনের কার্যত কর্তৃপক্ষ হিসেবে আরাকান আর্মির প্রতি আমাদের আহবান পুনর্ব্যক্ত করছি। ’
তহবিল ঘাটতির কারণে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রিতদের জন্য পরিষেবা কমানো হলেও রোহিঙ্গা সম্প্রদায় ন্যায়বিচারের জন্য অক্লান্তভাবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাগুলোও এরই মধ্যে সাড়া দেওয়া শুরু করেছে। গত জুলাইতে কঙ্গো, বেলজিয়াম, স্লোভেনিয়া ও আয়ারল্যান্ড জেনোসাইড সংঘটনের অভিযোগে মায়ানমারের বিরুদ্ধে মামলায় হস্তক্ষেপ করার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে অনুমতি পেয়েছেন। তারা এরই মধ্যে এই মামলাকে সমর্থনকারী আরো সাতটি দেশের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে আর্জেন্টিনার একটি আদালত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে তাদের ভূমিকার অভিযোগে সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংসহ মায়ানমারের ২৫ জন জেনারেলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। আইসিসি প্রসিকিউটরও মিন অং হ্লাইংয়ের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির অনুরোধ করেছেন।
মায়ানমারের জন্য বিশেষ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ক্রিস্টোফার সিডোটি বলেছেন, মিন অং হ্লাইং এবং অন্য সামরিক নেতাদের আন্তর্জাতিক আদালতের সামনে আনা রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সবচেয়ে অর্থবহ অবদান।
বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। সহায়তা কমায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে ক্ষুধা ও অপুষ্টি বাড়ছে। মাদক চোরাচালান, মানবপাচার এবং অস্ত্র বাণিজ্যেও জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা।
২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ ও মায়ানমার অন্তত তিনবার আনুষ্ঠানিক আলোচনা করেছে। চীন ও অন্যান্য মধ্যস্থতাকারী দেশের সহায়তায় দুবার প্রত্যাবাসনের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এর কারণ হলো, মায়ানমারে এখনো নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। বরং ২০২১ সালে মায়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে গেছে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য নাগরিকত্ব নিশ্চিত না হওয়া এবং সহিংসতা চলমান থাকায় কেউ স্বেচ্ছায় ফেরত যেতে চায় না। আর রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ এখন কার্যত আরাকান আর্মির হাতে।
বাংলাদেশ সরকার বরাবরই বলছে, এই সংকটের সমাধান কেবল মানবিক নয়, এটি রাজনৈতিক। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে ফেরত পাঠানোই একমাত্র টেকসই সমাধান।
রোহিঙ্গা ঢলের বার্ষিকী উপলক্ষে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর বলেছে, ‘আমাদের এখন এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করতে হচ্ছে, এ চলমান অপরাধের স্থায়ী দুর্দশা কখন শেষ হবে, বিশেষ করে দীর্ঘস্থায়ী রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য। সহিংসতার চক্র ভাঙার জন্য শাস্তির অবসান এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব এবং সমতার অধিকার নিশ্চিত করা অপরিহার্য। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে রাখাইনে মানবাধিকার এবং মানবিক পরিস্থিতির তীব্র অবনতি হয়েছে, যা এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের জীবন হুমকির সম্মুখীন পরিস্থিতিকে আরো গভীর করে তুলেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার টার্ক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা বৃদ্ধির জন্য আহবান জানিয়েছেন।
সৌজনৌ: কালের কণ্ঠ