বিনিয়োগকারীদের ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’র পথ দেখালেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও। বললেন সবুর করতে।
নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে গিয়ে আর কটা দিন সবুর করার এ পথ বাতলে দিয়েছেন ড. আহসান এইচ মনসুর। আসলেই কি বিনিয়োগের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের করণীয় কিছু নেই? ব্যবসা-বিনিয়োগ বিষয়ক কোনো দায়িত্ব পালন করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক? বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষ নয়। সরাসরি বিনিয়োগ করে না, কিন্তু ভূমিকা তো রাখছে। নীতিনির্ধারণ ও প্রণোদনা প্রদানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা অপরিসীম।
বৃহত্তর বিনিয়োগের বিষয়টি ভিন্ন। এসএমই, নারীনির্ভর উদ্যোগ, সোলার, বায়োগ্যাস, ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, সরকারের বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তাসহ রিফাইন্যান্স স্কিমে একাধিক প্রণোদনা প্যাকেজে তহবিল বিতরণে মূল সমন্বয়কের ভূমিকা বাংলাদেশ ব্যাংকেরই। এটি শুধু একটি ‘রেগুলেটরি অথরিটি’ নয়, দেশের মুদ্রানীতির চালক, বিনিয়োগবান্ধব নীতির রচয়িতা এবং প্রণোদনা কাঠামোর প্রবর্তকও। বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি প্রকল্পে বিনিয়োগ না করলেও নির্দেশনা, তহবিল সংস্থান, রিফাইন্যান্স স্কিম এবং সুদনীতি প্রণয়নের মাধ্যমে পরোক্ষ বিনিয়োগকারী হিসেবে তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বের কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু ব্যাংক তদারকির কাজেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক রুরাল উন্নয়নে বিশেষ তহবিল প্রণয়ন করে। মালয়েশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য নীতিগত সহায়তা দেয়। ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক ইভেন্ট ড্রিভেন প্রণোদনা পরিকল্পনায় আর্থিক খাতকে চাঙা করায় ভূমিকা রাখে। নির্বাচিত সরকার আসার আগ পর্যন্ত চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকও বিনিয়োগের চলমান খরা কাটাতে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখতে পারে।
বিনিয়োগকারীদের ওয়েট অ্যান্ড সি নীতিতে ডুবিয়ে না রেখে হোম ওয়ার্কের মতো বিনিয়োগবান্ধব মনোভাব, ব্যাবসায়িক নীতির স্থিতিশীলতা ও আর্থিক নৈতিকতা নিশ্চিত করে বিনিয়োগ আস্থার পুনর্গঠন করতে পারে। পর্যবেক্ষক না থেকে ‘পরিবর্তনের চালক’ হতে বাধা নেই। কে না জানে দেশের শিল্প খাতের গত এক বছরের দুর্গতি? নতুন শিল্প স্থাপন বা কারখানা সমপ্রসারণে উদ্যোক্তাদের আগ্রহ দ্রুত কমে যাচ্ছে। আগে যারা স্বপ্ন দেখতেন নতুন মেশিন আনার, রপ্তানির বাজার বাড়ানোয় তারাই এখন ব্যাংকের কিস্তি মেটানো নিয়ে দুশ্চিন্তায়। ডলারসংকট, উচ্চ সুদের হার এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা তাদের আরো কাবু করে দিয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা এ সমস্যাকে আরো প্রকট করেছে। নির্বাচিত সরকার এলে পরিস্থিতি বদল হবে, তা বিনিয়োগকারীরাও কম জানেন না। তাই বলে ততক্ষণ পযর্ন্ত হাত-পা গুটিয়ে থাকবে আর লোকসান টানবেন তারা?
বিনিয়োগের ব্যাপারে করার কিছু নেই বলা বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যই বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি প্রায় ২০ শতাংশ কমে গেছে। ব্যবসায়ী-অর্থনীতিক, গবেষক না হয়েও উপলব্ধি করা যায়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া বিনিয়োগ সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাজনৈতিক অভিভাবকহীন দেশ। কারখানা দখল, পোড়ানোসহ নানা অঘটনের বিচার দেওয়ার জায়গা নেই। বহু শিল্প-কারখানা বন্ধ, হাজার হাজার শ্রমিক বেকার। ছোট উদ্যোক্তাদের বিলাপের শক্তিও নেই। বড় করপোরেট গ্রুপগুলোর অবস্থাও নাজুক। উৎপাদন বন্ধ ও খরচ বেড়ে যাওয়া এবং রপ্তানি আদেশ কমে যাওয়ায় লোকবল ছাঁটাই হচ্ছে। উৎপাদন কমানো এবং বিনিয়োগ স্থগিতের পথে তারা।
নানা ঢাকঢোল পেটানোর পরও দেশীয় বিনিয়োগের সমান্তরালে বিদেশি বিনিয়োগের অবস্থাও করুণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বিদায়ি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ (জুলাই-মার্চ) মাসে ৮৬ কোটি ডলারের নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১১৬ কোটি ডলার। তার মানে এ সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ২৬ শতাংশ। দেশি উদ্যোক্তাদের ব্যবসা-বিনিয়োগের পথ মসৃণ না হলে বিদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য তা হওয়ার কোনো কারণ নেই। বিনিয়োগ একটি দীর্ঘমেয়াদি ও চলমান প্রক্রিয়া। এটি কখনোই রাতারাতি ঘটে না। অন্তর্বর্তী সরকার অথবা নির্বাচিত সরকার আজ কোনো নীতিগত বা প্রশাসনিক উদ্যোগ নিলেই কাল বিনিয়োগ বেড়ে যাবে, সেই নিশ্চয়তা নেই। বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় দরকার, যাতে বিনিয়োগকারীরা পরিকল্পনা, প্রস্তুতি এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাদের সামনে সেই পথরেখা নেই। হাল নমুনায় প্রশ্ন জাগছে, নতুন সরকার এলেই বিনিয়োগের পরিস্থিতি পালানোর গ্যারান্টি আছে কি না? সরকার বদলাল রাজনৈতিক অস্থিরতা গেল না, আইন-শৃঙ্খলা পাল্টাল না, গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকট কাটল না, তখন কী হবে? নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং খাতে একটি ইতিবাচক সংস্কার এনে দিতে পারলে, অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক ঐকমত্য রচনা করে দিয়ে গেলে সেখানে একটা আশাবাদ যোগ হতে পারে। সেই সঙ্গে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য কমানোর একটা উপযুক্ত পদক্ষেপও জরুরি।
রেমিট্যান্স-জিডিপির একতরফা বড়াই সমীচীন নয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে ২৪৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। গত বছরের একই মাসের তুলনায় রেমিট্যান্স বেড়েছে ৫৬ কোটি ৪১ লাখ ডলার, যা ২৯.৪৮ শতাংশ। রেমিট্যান্স স্থায়ী বিষয় নয়। গত বছর জুলাই আন্দোলনের মধ্যে সরকারকে অসহযোগিতার জন্য রেমিট্যান্স না পাঠানোর ডাক দেয় ছাত্র-জনতা। এতে রেমিট্যান্স কমে ১৯১ কোটি ডলারে নেমে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বৈধ চ্যানেলে মোট ৩০.৩৩ বিলিয়ন বা তিন হাজার ৩৩ কোটি ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। আগের অর্থবছর এসেছিল দুই হাজার ৩৯১ কোটি ডলার। এর মানে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৬৪১ কোটি ডলার বা ২৬.৮২ শতাংশ। সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নতির কারণে গত জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ বেড়ে ৩১.৭৭ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে, যা ২৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বশেষ ২০২৩ সালের মার্চের শুরুতে রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছিল। আর জুন শেষে বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৬.৭৪ বিলিয়ন ডলার।
২০২৩ সালের জুন থেকে আইএমএফের শর্ত মেনে হিসাব প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সময় রিজার্ভ ছিল ২৪.৭৫ বিলিয়ন ডলার। দেশের ইতিহাসে রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে ২০২১ সালের আগস্টে। সেখান থেকে কমতে কমতে আওয়ামী লীগ পতনের সময় রিজার্ভ নেমে আসে ২০.৪৮ বিলিয়ন ডলারে। আইএমএফের পরামর্শে গত বছরের ৮ মে ডলার দরে ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় এক লাফে প্রতি ডলারে সাত টাকা বাড়িয়ে মধ্যবর্তী দর ঠিক করা হয় ১১৭ টাকা। এরপর ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স দ্রুত বাড়তে থাকে।
তবে জুলাই আন্দোলন শুরুর পর রেমিট্যান্স শাটডাউনের ডাক, ব্যাংক বন্ধসহ বিভিন্ন কারণে প্রবাসী আয়ে ছন্দপতন হয়। জিডিপিতেও হিসাব ও খরচের ফের আছে। জরুরি খরচও না করে টাকা জমানোর মাঝে অঙ্কের সামর্থ্য দেখানো যায়। গর্ব করা যায় না। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে বিনিয়োগকে দেখা হয় মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির অনুপাতে। দেশে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছর জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের হার ২৩.৫১ শতাংশ, যা এর আগের অর্থবছর ছিল ২৪.১৮। অর্থাৎ গত অর্থবছর বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমেছে। জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগের বর্তমান পরিস্থিতি জানতে অপেক্ষা করতে হবে চলতি অর্থবছর শেষ হওয়া পর্যন্ত। তবে বিনিয়োগের পরিস্থিতিতে শিল্পের যন্ত্রপাতি কতটা আমদানি হচ্ছে, কাঁচামাল কতটা আসছে, ঋণ বিতরণ কতটা বেড়েছে, তা বোঝা যায় সূচক দিয়ে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হয়।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন